বরিশালে বিএনপির নেতৃত্ব নিয়ে চলছে নানা বিতর্ক। সর্বশেষ গত শনিবার যুবদল, ছাত্রদল ও স্বেচ্ছাসেবক দল বরিশালে যে বিভাগীয় ‘তারুণ্যের সমাবেশ’ করে, তাতে বরিশাল অঞ্চলের বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতাদের আমন্ত্রণ জানায়নি। এর আগে দলীয় সিদ্ধান্ত উপেক্ষা করে বরিশাল সিটি করপোরেশন নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ায় ১৯ নেতাকে দল থেকে আজীবনের জন্য বহিষ্কার করা হয়। বহিষ্কারের চিঠির ভাষা নিয়েও ক্ষোভ-আলোচনা আছে। সার্বিক বিষয় নিয়ে প্রথম আলো কথা বলেছে মজিবর রহমান সরোয়ারের সঙ্গে। তিনি বিএনপির কেন্দ্রীয় যুগ্ম মহাসচিব। তিনি দীর্ঘদিন বরিশাল জেলা ও নগর বিএনপির সভাপতি ছিলেন। বরিশাল-৫ আসনে পাঁচবারের সংসদ সদস্য ছিলেন। বরিশাল সিটি করপোরেশনের প্রথম মেয়র হিসেবে তিনি দায়িত্ব পালন করেছেন। তবে ২০২১ সালের নভেম্বরে মহানগর বিএনপির কমিটি ভেঙে দিয়ে আহ্বায়ক কমিটি করা হলে তিনি বাদ পড়েন। সেই থেকে বিভাগের কোনো দলীয় কর্মকাণ্ডে তাঁকে দেখা যায় না।
আপনি দীর্ঘদিন বরিশাল জেলা ও নগর বিএনপির সভাপতি ছিলেন। দলকে শক্তিশালী করতে ভূমিকা রেখেছেন। এখন কীভাবে চলছে বরিশালের বিএনপি?
মজিবর রহমান সরোয়ার: মূলত আমাদের দলের গঠনতন্ত্রে ‘এক নেতা, এক পদ’ নীতি সংযোজন হওয়ার পর আমি স্থানীয় পদ ছেড়ে কেন্দ্রীয় রাজনীতিতে সম্পৃক্ত হই। আমাদের অনেক নেতাই এটা করেছেন। তবে আমি সভাপতির পদ ছাড়ার পর বরিশালে একটি ‘ক্রাইসিস’ তৈরি হয়েছে। সেটা হচ্ছে সমন্বয়হীনতা। সাবেক মহানগর কমিটি এবং ৩০টি ওয়ার্ড কমিটির সাবেক নেতাদের সঙ্গে বর্তমান আহ্বায়ক কমিটির সমন্বয় নেই। আমি ব্যক্তিগতভাবে চেয়েছি এবং এখনো চাই এ সমন্বয় হোক। সমন্বয় না হওয়ার কারণে দলের ত্যাগী, পুরোনো বড় একটি অংশ এখন নিষ্ক্রিয়। এ কারণে ক্রাইসিসটা জটিল হচ্ছে। আমি চেষ্টা করছি উভয়ের মধ্যে সমন্বয় করে পূর্ণাঙ্গ শক্তির বিএনপির সাংগঠনিক অবস্থা তৈরি করার।
নগর বিএনপির আগের কমিটির অধিকাংশ নেতা এখন নিষ্ক্রিয়। ৩০টি ওয়ার্ড কমিটির অবস্থাও এমন। তাঁদের সক্রিয় করতে কোনো উদ্যোগ আছে?
মজিবর রহমান সরোয়ার: আমি আগেই বলেছি, আমি এটা শুরু থেকেই চেয়েছি। কিন্তু হয়ে ওঠেনি। এ ক্ষেত্রে আন্তরিকতার ঘাটতি অবশ্যই ছিল। কিন্তু চেষ্টা তো আমরা থামাইনি। কারণ, দুই বছর ধরে দলের বড় একটি শক্তি দলীয় কর্মসূচিতে অংশ নিতে পারছেন না বা নিচ্ছেন না। অথচ এসব নেতা-কর্মীই বরিশালে বিএনপির প্রাণ। তাঁদের বাদ দিয়ে দল চালালে তো দলই ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এসব নেতা-কর্মীর বিরুদ্ধে অসংখ্য মামলা আছে, তাঁরা জেল খেটেছেন, নির্যাতন সহ্য করেছেন। তাঁরা বিএনপিকে বরিশালে শক্তিশালী অবস্থানে রেখেছেন। আমি কেন্দ্রীয় নেতাদের সঙ্গে কথা বলেছি। ঈদের পর এ বিষয়ে সক্রিয় উদ্যোগ নেওয়া হবে।
গত সিটি নির্বাচনে বিএনপি অংশ নেয়নি। এরপরও নগর বিএনপির বর্তমান কমিটির ও অঙ্গসংগঠনের অনেক নেতার বিরুদ্ধে মেয়র-কাউন্সিলর প্রার্থীদের পক্ষে কাজ করার অভিযোগ উঠেছে। বিজয়ীদের মিষ্টিমুখ করানো, ফুল দিয়ে শুভেচ্ছা জানানোর ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে এসেছে। এটাকে কীভাবে দেখছেন?
মজিবর রহমান সরোয়ার: আমি বলব, এটা হচ্ছে রাজনীতিতে অনভিজ্ঞতার কারণে। রাজনীতির সংস্কৃতি, সচেতনতা, অভিজ্ঞতা না থাকা ব্যক্তিদের দায়িত্ব দিলে এমনটা যে হয়, সেটা এর উদাহরণ। কারণ, এখন দেশে চূড়ান্ত আন্দোলন শুরু হয়েছে। আমাদের চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া মিথ্যা মামলায় কারাবন্দী। আমাদের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান মিথ্যা মামলায় দেশে আসতে পারছেন না। সেই অবস্থায় দলীয় পদ-পদবিতে থেকে সিটি নির্বাচনে অংশগ্রহণ, পক্ষসমর্থন, শুভেচ্ছা জানানো আত্মঘাতী। আমার মনে হয়, এমন ব্যক্তিদের দলের নেতৃত্বে দূরে থাক, দলেই রাখা উচিত নয়।
দলের এই বিভক্তি চলমান আন্দোলনে কোনো প্রভাব ফেলছে?
মজিবর রহমান সরোয়ার: রাজনীতিতে আমরা এখন কঠিন সময় পার করছি। আমাদের চূড়ান্ত আন্দোলন শুরু হয়ে গেছে। এই কঠিন অবস্থার মধ্যে এখানে তৃণমূলে যাঁরা আছেন, তাঁরা যে সুযোগ-সুবিধা নেওয়ার জন্য এসেছেন, এখন বোঝা যায়। না হলে তাঁরা নির্বাচনে গেল কীভাবে? চূড়ান্ত আন্দোলনের সময়ে এটা আত্মঘাতী। এতে অবশ্যই দল এবং চলমান আন্দোলনে প্রভাব পড়তে পারে।
সম্প্রতি বরিশালে বিভাগীয় তারুণ্যের সমাবেশ হয়ে গেল। সেখানে আপনিসহ এ অঞ্চলের কেন্দ্রীয় কোনো নেতাকে মঞ্চে দেখা যায়নি। এটা কোনো ধরনের উপেক্ষার ইঙ্গিত, নাকি ভিন্ন কোনো কারণে এটা করা হয়েছে?
মজিবর রহমান সরোয়ার: বরিশালে খুব বড় আয়োজন ছিল এটা। আর আমি বরিশালে দীর্ঘদিন নেতৃত্বে ছিলাম, জনপ্রতিনিধি ছিলাম। আমাকে মঞ্চে না দেখে অনেকেই প্রশ্ন করেছেন। তবে শুধু আমাকে নয়, এ অঞ্চলের কোনো কেন্দ্রীয় নেতাদেরই রাখা হয়নি। এই অনুষ্ঠান আয়োজনের প্রক্রিয়ার সঙ্গে যাঁরা যুক্ত ছিলেন, তাদের কিছু ত্রুটি থাকতে পারে। তবে আমি বলব, এখানে তরুণ-প্রবীণের সমন্বয় থাকলে আরও ভালো হতো। আমরা তরুণদের শোনাতে পারতাম, কঠিন সময়কে মোকাবিলা করে আমরা কীভাবে টিকে থেকেছি। তবে এ নিয়ে কোনো আক্ষেপ বা ক্ষোভ নেই।
বরিশালে দলকে সংগঠিত করতে এখন কী কী উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন বলে মনে করেন?
মজিবর রহমান সরোয়ার: বরিশালে দলকে পূর্ণশক্তিতে রূপ দিতে হলে প্রথমেই একটি সম্মেলনের মাধ্যমে নেতৃত্ব নির্বাচন করা প্রয়োজন। দলের জন্য পরীক্ষিত, অভিজ্ঞ—এমন নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করা দরকার। একই সঙ্গে যে সমন্বয়হীনতা আছে, তা নিরসন করা প্রয়োজন।