সিলেটের রাজনীতিতে আবার আলোচনায় ‘টিলাগড় গ্রুপ’ 

সিলেট নগরের ২০ নম্বর ওয়ার্ডে টিলাগড় এলাকা। দীর্ঘদিন ধরে এলাকাটিতে আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে প্রভাবশালী দুটি পক্ষ তৎপর। ‘টিলাগড় গ্রুপ’ নামে পরিচিতি পাওয়া এসব বলয় অভ্যন্তরীণ সংঘর্ষ, বিতর্কিত কর্মকাণ্ড ও খুনোখুনির কারণে প্রায়ই আলোচনায় থাকে। সম্প্রতি সেখানে নতুন আরেকটি পক্ষ তৈরি হয়েছে। নতুন পক্ষের অনুসারীরা গত বৃহস্পতিবার রাতে পুরোনো পক্ষের শীর্ষ এক নেতার বাসভবনে হামলা চালান। এরপরই আবার নতুন করে টিলাগড় গ্রুপ আলোচনায় এসেছে।

স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, নব্বইয়ের দশকে টিলাগড় গ্রুপের আত্মপ্রকাশ ঘটে। যৌথভাবে তখন গ্রুপের নেতৃত্ব দিতেন তৎকালীন ছাত্রনেতা রণজিৎ সরকার ও আজাদুর রহমান। পরে তাঁরা ছাত্রলীগ-যুবলীগে গুরুত্বপূর্ণ পদপদবিও পান। এখন উভয়ই আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেতা ও জনপ্রতিনিধি। 

দীর্ঘদিন একত্রে টিলাগড় গ্রুপ চালালেও ২০১৪ সালের ৮ সেপ্টেম্বর জেলা ছাত্রলীগের কমিটি গঠনের সূত্র ধরে রণজিৎ ও আজাদুরের মধ্যে প্রথমবারের মতো বিরোধ স্পষ্ট হয়। এরপরই টিলাগড় গ্রুপ বিভক্ত হয়ে পড়ে। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি শফিকুর রহমান চৌধুরী প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব পেলে টিলাগড়ে আরেকটি পক্ষ তৈরি হয়। মূলত নতুন পক্ষের কিছু কর্মী আজাদের বাসায় গত বৃহস্পতিবার মধ্যরাতে হামলা চালান।

অবশ্য প্রতিমন্ত্রী শফিকুর রহমান চৌধুরী নতুন পক্ষ তৈরির বিষয়টি অস্বীকার করে প্রথম আলোকে বলেন, ‘যারা হামলা করেছে, তারা অশিক্ষিত, চোর-ডাকাত। আমার কোনো বলয়টলয় নেই। এই হামলার সাহস ওরা পেল কোথায়? আজাদ মুরব্বি মানুষ, তাঁর বাসায় হামলা করে তারা চরম ধৃষ্টতা দেখিয়েছে। যে বা যারা এর সঙ্গে জড়িত, তারারে শাস্তিমূলক ব্যবস্থায় নিয়ে আসতে হবে। এদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দেওয়া কোনোভাবেই কারও ঠিক হবে না।’

সিলেট জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক রণজিৎ সরকার গত নির্বাচনে সুনামগঞ্জ-১ (তাহিরপুর-জামালগঞ্জ-ধর্মপাশা-মধ্যনগর) আসনের সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। তাঁর বাসা টিলাগড়ের পাশঘেঁষা গোপালটিলা এলাকায়। অন্যদিকে সিলেট সিটির ২০ নম্বর ওয়ার্ডের টানা পঞ্চমবারের কাউন্সিলর মহানগর আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক আজাদুর রহমানের বাসা টিলাগড়ের পাশে পূর্ব শাপলাবাগ এলাকায়।

দলীয় কয়েকজন নেতা জানান, সিলেট এমসি কলেজ ও সিলেট সরকারি কলেজের অবস্থান টিলাগড়ে। পাশেই সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ও সিলেট ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ। মূলত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকেন্দ্রিক ছাত্রলীগের আধিপত্য ধরে রাখতে রণজিৎ ও আজাদুরের কর্মীরা তৎপর। একের পর এক হত্যা ও অপকর্মে প্রায়ই রণজিৎ ও আজাদুর বলয়ের নেতা-কর্মীদের নাম সামনে আসে। টিলাগড়ে নেতিবাচক কিছু ঘটলেই দুই পক্ষের প্রধানের নামই আলোচনায় আসে।

একাধিক সূত্র নিশ্চিত করেছে, একসময় রণজিৎ ও আজাদুরের কর্মী-সমর্থকদের পাল্লা প্রায় সমান ছিল। সিলেট-১ (নগর-সদর) আসনের সংসদ সদস্য ও সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেনের ঘনিষ্ঠ হওয়ায় আজাদুর দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের আগে প্রভাবের দিক দিয়ে এগিয়ে ছিলেন। গত বছরের ২১ জুন সিলেট সিটি নির্বাচনে আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী মেয়র নির্বাচিত হলে রণজিতের প্রভাব বেড়ে যায়। বর্তমানে টিলাগড় এলাকায় রণজিতের অনুসারীদের একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ রয়েছে। এর মধ্যে টিলাগড়ের পাশে কল্যাণপুরের বাসিন্দা প্রতিমন্ত্রী শফিকুর রহমান চৌধুরীর আরেকটি পক্ষ তৈরি হলে টিলাগড় গ্রুপের রাজনীতিতে নতুন করে অস্থিরতা দেখা দেয়।

প্রতিমন্ত্রীর অনুসারীর নেতৃত্বে পক্ষ তৈরি হওয়ার পর কিছু নেতা-কর্মী স্থানীয়ভাবে চাঁদাবাজিসহ বিভিন্ন অপকর্ম করার চেষ্টা করেন। সম্প্রতি কোরবানির পশুর হাটে আজাদুরের অনুসারীদের সঙ্গে চাঁদাবাজির দ্বন্দ্বের জেরে নতুন পক্ষের কিছু কর্মী আজাদুরের বাসায় হামলা চালান। এর জেরে আজাদুর ও রণজিতের অনুসারীরা তাৎক্ষণিকভাবে একত্র হয়ে যান। দুই পক্ষের অনুসারীরা ওই রাতে ও পরদিন শফিকুরের একাধিক অনুসারীর বাসায় ভাঙচুর চালান।

হামলার বিষয়ে আজাদুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘এলাকায় চাঁদাবাজি, হামলা-দখলবাজি করছে চিহ্নিত একটি মাদকসেবী চক্র। তাদের বিরুদ্ধে এলাকাবাসী বিভিন্ন সময় আমার কাছে অভিযোগ করেছে। সেসব অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে তাদের বিরুদ্ধে আমার অবস্থান ছিল। ওই ক্ষোভ থেকেই তারা হামলা চালিয়েছে।’

আওয়ামী লীগের নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, টিলাগড়কেন্দ্রিক ছাত্ররাজনীতির দাপটে মানুষ ভয়ে থাকেন। ছাত্রলীগের কোন্দলে ২০১০ থেকে ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ১০ বছরে ছাত্রলীগের পাঁচ কর্মী খুন হন। এর বাইরে সংঘাত, অস্ত্রবাজি ও দুর্বৃত্তপনার ঘটনা ঘটেছে। ২০১৩ সালের ১৯ মে এমসি কলেজে প্রকাশ্যে আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে মহড়া হয়। ২০১৬ সালের ৭ মার্চ আরেক দফা অস্ত্রবাজি হয়। নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা নিয়ে ২০১২ সালের ৮ জুলাই ছাত্রলীগ ও ছাত্রশিবিরের মধ্যে সংঘর্ষে ছাত্রাবাসে আগুন দেওয়া হয়। এ ছাড়া ২০১৯ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর এমসি কলেজ ছাত্রাবাসে স্বামীকে আটকে রেখে এক তরুণীকে দলবদ্ধ ধর্ষণের ঘটনা ঘটে। 

এ ঘটনার অভিযুক্তরা ছাত্রলীগের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতা-কর্মী। এর বাইরে গত দুই বছরে সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে অন্তত ছয়বার ছাত্রলীগের দুই পক্ষের সংঘর্ষ হয়। প্রতিটি ঘটনায় রণজিৎ-আজাদের অনুসারীরা যুক্ত ছিলেন বলে অভিযোগ আছে। আজাদের বাসায় হামলা পুরোনো সংঘাতকে উসকে দেওয়ার শঙ্কা আছে।

এসব বিষয়ে সংসদ সদস্য রণজিৎ সরকারের সঙ্গে কথা বলা সম্ভব হয়নি। তাঁর এক অনুসারী প্রথম আলোকে বলেন, অতীতেও রণজিৎ-আজাদুরের দ্বন্দ্বে অভ্যন্তরীণ সংঘর্ষ ও প্রভাব বিস্তারের ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু যত বড় সংঘর্ষই হোক না কেন, কখনোই তাঁদের কারও বাসভবনে হামলার ঘটনা ঘটেনি। এবার যা ঘটল, খুবই দুঃখজনক ও নিন্দনীয়। এর জেরে কী ঘটবে, অনুমান করাও মুশকিল।