বিয়ের পর শাশুড়ির সঙ্গে দ্বন্দ্ব, বাড়ি ছেড়েও আগুনে পুড়ে মৃত্যু হলো হালিমার
স্কুলজীবন থেকে প্রেম। কলেজে এসে গভীর হয় সম্পর্ক। শুরুতে অমত থাকলেও পরে পারিবারিকভাবে বিয়ে হয় হালিমা আক্তারের (২০)। কিন্তু এরপরই শুরু হয় শাশুড়ির সঙ্গে দ্বন্দ্বের, যা গড়ায় সালিস পর্যন্ত। একপর্যায়ে শ্বশুরবাড়ি ছেড়ে স্বামীর সঙ্গে ওঠেন ভাড়া বাড়িতে। সেখানেই হাত–পা বেঁধে আগুন দেওয়া হয় হালিমার শরীরে। তাঁর সঙ্গে দগ্ধ হয় ছয় মাসের ছেলে জিসানও।
ঢাকার শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে চিকিৎসাধীন অবস্থায় গতকাল শুক্রবার মৃত্যু হয় হালিমার। দগ্ধ শিশুসন্তান জিসান সংকটাপন্ন অবস্থায় সেখানে চিকিৎসাধীন।
ঘটনাটি ঘটেছে পটুয়াখালীর দুমকিতে। ৮ জুন বিকেলে উপজেলার নতুন বাজারসংলগ্ন শাহজাহান মুন্সির ভাড়া বাড়ি থেকে হালিমা ও তাঁর ছয় মাসের ছেলে জিসানকে দগ্ধ অবস্থায় উদ্ধার করেন প্রতিবেশীরা। এ ঘটনায় হালিমা আক্তারের মামা ওমর ফারুক বাদী হয়ে দুমকি থানায় একটি হত্যা মামলা করেছেন। মামলায় নিহত গৃহবধূর শাশুড়ি পিয়ারা বেগমসহ অজ্ঞাতনামা তিন-চারজনকে আসামি করা হয়েছে। পুলিশ শাশুড়ি পিয়ারা বেগমকে গ্রেপ্তার করেছে। পিয়ারার সঙ্গে দ্বন্দ্বের জেরে পরিকল্পিতভাবে হালিমাকে পুড়িয়ে হত্যা করা হয়েছে বলে অভিযোগ স্বজনদের।
হালিমাদের বাড়ি দুমকি উপজেলার আঙ্গারিয়া ইউনিয়নের সাতানি গ্রামে। এক ভাই ও এক বোনের মধ্যে হালিমা বড়। তাঁর বাবা মজিবুর রহমান হাওলাদার বিভিন্ন জটিল রোগে আক্রান্ত। চিকিৎসার জন্য প্রায়ই তাঁকে ঢাকায় থাকতে হয়। এ সময় হালিমার মা ফাতেমা বেগমও স্বামীর সঙ্গে থাকেন। এ অবস্থায় খালু লাল মিয়ার বাড়িতে থেকে হালিমা লেখাপড়া করেছেন।
আজ শনিবার সকালে দুমকি উপজেলায় সরেজমিনে হালিমার স্বজন ও স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মেধাবী শিক্ষার্থী হালিমা উচ্চমাধ্যমিকে জিপিএ-৫ পেয়েছেন। তাঁর স্বামী জামাল হোসেন একই কলেজ থেকে অনার্স শেষ করেন। দুই পরিবারই তাঁদের দুজনের সম্পর্ক মেনে নিতে পারছিল না। একপর্যায়ে পরিবারের সম্মতিতে বিয়ে হয়। বিয়ের পর শ্বশুরবাড়িতে ওঠেন হালিমা। চার বছরের সংসারজীবনে তাঁদের কোলে আসে ফুটফুটে পুত্রসন্তান জিসান।
প্রতিবেশী ও স্বজনেরা বলছেন, বিয়ের পর থেকেই বউ-শাশুড়ির মধ্যে পারিবারিক বিরোধ দেখা দেয়। তবে সন্তান জন্মের পর থেকে তাঁদের দ্বন্দ্বের বিষয়টি প্রকাশ্যে আসে। একজন অপরজনের বিরুদ্ধে পাল্টাপাল্টি অভিযোগ করতে থাকেন। এ নিয়ে এলাকায় একাধিকবার সালিস বৈঠকও হয়েছে। সবশেষ সালিস বৈঠক হয়েছে গত ৩০ মে সন্ধ্যায়। সেখানে ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য সোহরাব হাওলাদারসহ স্থানীয় ব্যক্তিবর্গ উপস্থিত ছিলেন।
সালিসে উপস্থিত থাকা হালিমার খালু লাল মিয়া বলেন, সালিসে বউ-শাশুড়ির পাল্টাপাল্টি অভিযোগের পর একই বাড়িতে বসবাস কঠিন হয়ে পড়ায় জামাল হোসেন তাঁর স্ত্রী ও সন্তানকে নিয়ে দুমকি উপজেলা শহরের নতুন বাজার এলাকায় আলাদা ভাড়া বাড়িত ওঠেন।
নতুন বাজার এলাকায় হালিমার প্রতিবেশীরা জানান, গত বৃহস্পতিবার (৮ জুন) দুপুরের খাবার খেয়ে বিশ্রাম নিচ্ছিলেন হালিমা। জামাল হোসেন দুপুরের খাবার খেয়ে দুমকি বাজারে তাঁর কর্মস্থল কম্পিউটারের দোকানে চলে যান। বেলা তিনটার দিকে হঠাৎ হালিমার ডাকচিৎকার শুনে প্রতিবেশীরা ছুটে আসেন। তাঁরা বাইরে থেকে দরজার ছিটকিনি বন্ধ পান। পরে তাঁরা ভেতরে ঢুকে শাড়ি ও ওড়না দিয়ে হাত-পা বাঁধা অবস্থায় অগ্নিদগ্ধ হালিমা আক্তারকে উদ্ধার করেন। এ সময় তাঁর শিশুপুত্রের হাতসহ বিভিন্ন স্থান আগুনে ঝলসানো ছিল। প্রতিবেশীরা দুজনকে দ্রুত বরিশাল শের–ই–বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠিয়ে দেন। পরে রাতেই তাঁদের ঢাকার শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে পাঠানো হয়।
এ ঘটনায় করা মামলার এজাহারে উল্লেখ করা হয়েছে, দুজন মুখোশ পরিহিত অবস্থায় ঘরে ঢুকে কাপড় দিয়ে হালিমার হাত, পা ও মুখ বেঁধে গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন দেয়। এরপর বাইরে থেকে দরজা লাগিয়ে চলে যায়। পিয়ারা বেগম ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের পরিকল্পনায় ও যোগসাজশে অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিরা হালিমাকে হত্যার উদ্দেশ্যে হাত, পা ও মুখ বেঁধে গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন দিয়েছে বলে এজাহারে উল্লেখ করা হয়েছে।
এদিকে গ্রেপ্তারের আগে পিয়ারা বেগম সাংবাদিকদের কাছে দাবি করেন, ছেলের বউ হালিমা তাঁর বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ করেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে হওয়া সালিস বৈঠকে তা মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে। তাঁরা (ছেলে ও ছেলে বউ) অন্য জায়গায় চলে গেছেন। কোথায় গেছেন, তাঁরা কিছুই জানতেন না।
হালিমার স্বামী জামাল হোসেন মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, ‘স্ত্রী মারা গেছে। জিসান (শিশুসন্তান) এখনো সংকটাপন্ন। মাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। আসলে আমি কী বলব? তবে আমি চাই, সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে সত্য উদ্ঘাটন হোক।’
দুমকি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. আবুল বাশার বলেন, তাঁদের পারিবারিক বিরোধ ছিল। এ জন্য কিছুদিন আগে ঘর ভাড়া করে আলাদা থাকা শুরু করেন। ঘটনার সঙ্গে যাঁরা সরাসরি জড়িত, তাঁদের শনাক্ত ও গ্রেপ্তারে অভিযান চলছে।