প্রতিবন্ধীদের উৎসবের দিন ছিল আজ

প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অভিনীত নাটক ‘একইভূত আলোর পথে’ উপভোগ করছেন দর্শকেরা। আজ মঙ্গলবার খুলনার কয়রার মহারাজপুর ইউনিয়ন পরিষদ চত্বরেছবি: প্রথম আলো

সমুদ্র উপকূলবর্তী সুন্দরবনের কোল ঘেঁষে অবস্থিত খুলনার কয়রা উপজেলা। এর প্রধান সড়কের পাশেই মহারাজপুর ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি)। অন্য সময় ইউনিয়নের নানা মানুষের পদচারণ থাকে এখানে। তবে আজ মঙ্গলবার দিনটি ছিল একেবারেই অন্য রকম।

সকাল সাড়ে ১০টার দিকে কয়রার মহারাজপুর ইউপিতে পৌঁছে দেখা যায়, পরিষদ চত্বর ঘিরে নির্মিত হয়েছে অস্থায়ী প্যান্ডেল। তার মধ্যে চেয়ারের সারিতে বসা প্রতিবন্ধী নারী-পুরুষের দল। স্টেজে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অভিনীত নাটক মঞ্চস্থ হচ্ছে। মুগ্ধ হয়ে উপভোগ করছেন বিপুলসংখ্যক নারী-পুরুষ।

৩৩তম আন্তর্জাতিক প্রতিবন্ধী দিবস উপলক্ষে আজ দিনভর উপজেলার প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের নিয়ে এমন আয়োজন করে বেসরকারি সংস্থা কারিতাস বাংলাদেশ ও ডিজঅ্যাবল্ড চাইল্ড ফাউন্ডেশন।

নাটকের কাহিনি সমাজের কয়েকজন প্রতিবন্ধী নারী-পুরুষকে নিয়ে। দৈনন্দিন নানা টানাপোড়েন এক অসহায় আবর্তে বেঁধে রেখেছে যাদের। প্রতিনিয়ত কী ধরনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হয়, দুর্যোগের সময় কী কী বাধার সম্মুখীন হয় তারা; প্রতিবন্ধী নারীদের রোজকার কত অপমান, লাঞ্ছনা সহ্য করতে হয়; সবকিছু পেছনে ফেলে সংঘবদ্ধভাবে তাদের জ্বলে ওঠার চেষ্টার গল্প ছিল নাটকটিতে। সেই সঙ্গে জনপ্রতিনিধি ও সুস্থ স্বাভাবিক মানুষদের সমাজে প্রতিবন্ধী মানুষের সঙ্গে ব্যবহার ও সুরক্ষা প্রদানে করণীয় বিষয়গুলো নিয়ে মঞ্চস্থ হয় ‘একইভূত আলোর পথে’ নামের নাটকটি।

নাটক শেষে উপস্থিত দর্শকেরা অভিনেতাদের সঙ্গে আলাপচারিতায় তাঁদের অনুভূতি প্রকাশ করেন। এরপর প্রতিবন্ধীদের অংশগ্রহণে শুরু হয় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও খেলাধুলা।

অনুষ্ঠানের এক পর্যায়ে প্যান্ডেলের এক পাশে গোল হয়ে বসে বালিশ খেলায় মেতেছিল প্রতিবন্ধী নারীদের দল। অপর পাশে প্রতিবন্ধী পুরুষদের দলটি খেলছিল ঝুড়িতে বল নিক্ষেপ খেলা। তাদের কেউ দৈহিকভাবে বিকলাঙ্গ, কেউ আবার মানসিকভাবে ভারসাম্যহীন। অনেকেই স্বাভাবিক জীবনযাপনে অক্ষম। স্বাভাবিকভাবে খেলতে না পারলেও সবার মুখে ছিল আনন্দের হাসি।

খেলায় অংশ নেওয়া সুমাইয়া খাতুনের ছোটবেলা থেকে এক হাত অবশ। তিনি বলেন, আজকের এই আনন্দ ছিল তাঁর জীবনের সেরা সময়।

সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে গান গেয়েছিলেন দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী নয়ন মন্ডল। তার আধো আধো জড়ানো কণ্ঠে ‘তুমি কি দেখেছ কভু জীবনের পরাজয়’ গানটিতে অনেক দর্শকের চোখ ভিজে গিয়েছিল। নয়ন বলেন, ‘আমি আজ মঞ্চে উঠে মাইকে গান গাইতে পেরে খুবই আনন্দিত। চোখে না দেখলেও কানে শুনেছি অনেক মানুষ হাতে তালি দিয়েছে। আমি চাই, আমার মতো যারা প্রতিবন্ধী রয়েছে, তাদের সবার জন্য এমন কিছুর আয়োজন করা হোক।

সাংস্কৃতিক ও ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে বিজয়ীদের হাতে পুরস্কার তুলে দেন মহারাজপুর ইউপি চেয়ারম্যান আব্দুল্লাহ আল মাহমুদ।

অনুষ্ঠানের আয়োজক বেসরকারি সংস্থা কারিতাস বাংলাদেশের প্রকল্প পরিচালক সুব্রত মল্লিক বলেন, খেলাধুলা, গান, অভিনয়, আনন্দ এসবের মাধ্যমে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের সমাজের মূল স্রোতোধারায় আনাই এমন অনুষ্ঠানের মূল উদ্দেশ্য। শারীরিকভাবে সক্ষম ব্যক্তিদের সঙ্গে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে ও প্রতিযোগিতায় প্রতিবন্ধীদের অংশ নেওয়ার সুযোগ করে দিলে সক্ষম ব্যক্তিরা প্রতিবন্ধীদের সমস্যা বুঝতে পারবে। পাশাপাশি প্রতিবন্ধীরাও আনন্দ পাবে।

অনুষ্ঠান দেখতে আসা কয়রা কপোতাক্ষ মহাবিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক ছদর উদ্দীন আহমেদ বলেন, জীবনে এমন দিন খুব কমই আসে, অসম্ভব এক ভালো লাগা কাজ করছে মনপ্রাণজুড়ে। আসলে প্রতিবন্ধী মানুষেরাও সুযোগ পেলে সব কাজ করতে পারে। শুধু একটু সুযোগ-সুবিধা দরকার। আজ প্রতিবন্ধী নারী, পুরুষ, শিশুগুলোর সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে বারবারই আমার চোখ ভিজে গেছে। তাদের কষ্টের কথা শুনেছি। তারাও আমাদের মতো মানুষ। অথচ সমাজে তারা কত অবহেলিত।