কুড়িগ্রামের নদ-নদীর পানি কমে বন্যা পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হলেও ব্রহ্মপুত্র নদের পানি গত তিন দিনে আগের অবস্থাতেই আছে। ব্রহ্মপুত্র নদের শতাধিক চরের মানুষের মজুত খাদ্য ও জ্বালানি শেষ হয়ে গেছে। পবিত্র ঈদুল আজহার পর থেকে ব্রহ্মপুত্র অববাহিকার এসব চরের মানুষ পানিবন্দী হয়ে আছেন। অনেক চরে এখনো ত্রাণসহায়তা পৌঁছায়নি বলে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা জানিয়েছেন।
কুড়িগ্রাম পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) তথ্য অনুযায়ী, আজ বুধবার সকাল ৯টায় দুধকুমার নদের পানি বিপৎসীমার ৬২ সেন্টিমিটার, ধরলা নদীর পানি কুড়িগ্রাম সদর পয়েন্টে বিপৎসীমার ৮২ সেন্টিমিটার এবং তিস্তার পানি বিপৎসীমার ৫৭ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। তবে ব্রহ্মপুত্র নদের পানি দুই দিন থেকে বৃদ্ধি বা হ্রাস না পেয়ে নুনখাওয়া পয়েন্ট ও চিলমারী পয়েন্টে স্থির আছে।
গতকাল মঙ্গলবার কুড়িগ্রাম সদর উপজেলার যাত্রাপুর ইউনিয়ন, উলিপুর উপজেলার বেগমগঞ্জ, সাহেবের আগলা, চিলমারী উপজেলার সদর ইউনিয়ন ঘুরে এবং নয়ারচর ইউনিয়ন ও রাজীবপুর উপজেলার কোদালকাটি ইউনিয়নের চেয়ারম্যানদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ব্রহ্মপুত্র নদে বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হলে যাত্রাপুর ইউনিয়নের প্রায় ১ হাজার ১০০টি পরিবার পানিবন্দী হয়ে পড়ে। বন্যা পরিস্থিতি উন্নতি হওয়ার পর বর্তমানে ওই ইউনিয়নে ৬০০টি পরিবারের জন্য ত্রাণসহায়তা দরকার। কিন্তু তিনি ৪৫০টি পরিবারের জন্য ১০ কেজি করে চাল ত্রাণসহায়তা পেয়েছেন। সাহেবের আলগা ইউনিয়নের আটটি ওয়ার্ডের প্রায় সাড়ে ৪ হাজারের বেশি পরিবার পানিবন্দী হয়ে পড়ে। বন্যাকবলিত পরিবারের সহায়তার জন্য মাত্র তিন মেট্রিক টন চাল এবং ইউএনওর দেওয়া ১০০ প্যাকেট ত্রাণসামগ্রী বিতরণ করা হয়েছে।
চিলমারী উপজেলার নয়ারহাট ইউনিয়নে নদীভাঙন ও বন্যায় বজরা দিয়ারখাতা, কাজলডাঙ্গা, বাঁশপাতারি চর, উত্তর খাউরিয়ার চর, গয়নার পটল চরাঞ্চল মিলে ১ হাজার ৫০০-এর বেশি পরিবার পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। গয়নার পটল গ্রামের পানিবন্দী ৩০০ পরিবার কোনো ত্রাণসহায়তা পায়নি। একই উপজেলার চিলমারী সদর ইউনিয়নের আমতলী, মানুষমারার চর, শাখাহাতি, মোনতলা, গাজিরপাড়ায় ১ হাজার পরিবার পানিবন্দী। এ ছাড়া ওই ইউনিয়নের ৭ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে ভাঙন রয়েছে। কিন্তু ওই ইউনিয়নের কেউ ত্রাণসহায়তা পাননি। ৬০০ পরিবারের জন্য ত্রাণসহায়তা প্রয়োজন বলে চেয়ারম্যান জানিয়েছেন।
রাজীবপুর উপজেলার কোদালকাটি ইউনিয়নের সংকর মাধবপুর, উত্তর কোদালকাটি, চর সাজাই, কারিগরপাড়ায় সাড়ে ৩ হাজার পরিবার পানিবন্দী হয়েছিল। বর্তমানে বন্যা পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হলেও ১ হাজার ৫০০টি পরিবার পানিবন্দী অবস্থায় আছে। তাদের মধ্যে মাত্র ৪৫০টি পরিবারের মধ্যে ১০ কেজি করে চাল বিতরণ করা হয়েছে। ওই ইউনিয়নের নদীভাঙন ও বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত প্রায় ৪ হাজার পরিবারের জন্য জরুরি ত্রাণসহায়তা প্রয়োজন।
কুড়িগ্রামের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ সাইদুল আরীফ প্রথম আলোকে বলেন, ‘চলতি বন্যায় জেলার ৭৩টি ইউনিয়নের মধ্যে ৪৫টি ইউনিয়নের ১৮৫টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। ৯ উপজেলার ২০ হাজার পরিবারের মধ্যে ৬১ হাজার ৫৪ জন মানুষ পানিবন্দী অবস্থায় ছিল। বন্যার্ত মানুষের জন্য আমাদের পর্যাপ্ত বরাদ্দ আছে। যেসব এলাকায় ত্রাণ পৌঁছায়নি, ইউনিয়ন চেয়ারম্যানদের সঙ্গে সমন্বয় করে ত্রাণ পাঠানো হবে।’
কুড়িগ্রাম সদর উপজেলার খেওয়ার আলগার চরের বাসিন্দা বাদশা মিয়া বলেন, তিনি ঈদের দুই দিন আগে ঢাকা থেকে বাড়িতে এসেছেন। ঢাকায় রিকশা চালান তিনি। ঈদের পর বন্যা শুরু হলে তাঁর ঢাকা যাওয়া বন্ধ হয়ে যায়। তিনি বলেন, ‘ঘরত এক কোমর পানি। বাসায় আদি (বর্গা) নেওয়া দুইটা বাছুর গরু আছে। বানের পানিত পোয়াল (খড়) ভেসে গেছে। ঘরে চাল নাই। গরুর জন্য পোয়াল কিনমো তাঁর ট্যাকা নাই। ম্যালা সমস্যাত আছি গো ভাই, কোনডা থুয়ে কোনডা কই।’
বেগমগঞ্জ ইউনিয়নের দক্ষিণ বালাডোবা চরের বাসিন্দা লাল বানু বলেন, ‘আঙিনাত বুকসমান পানি। ঘরত এক কোমর। শান্তিমতো দুইডা ভাত রান্না করি খামো, তারও উপেয় নাই। জ্বালানি খড়ি বানের পানিত ভাসি গেইছে। জ্বালানি খড়ির খুব অভাব।’