‘এপ্রিল মাস আলেই সাংবাদিক ভাইয়েরা হামাগরে ফটো তুলব্যার আইসে। পেপারোত হামাগরে ফটো দিয়া খবোর ছাপায়। আর বচরের পর বচর যায়, কাউয়ো হামাগরে খবোর ন্যায় না। ঘটোনার পর থাকি হামরা খালি পেপারোত খবোর হবার নাগচি। হামাগরে ভাগ্যের খবোর আর হচ্চে না। এ্যাংকা করি আর কয়দিন চলবে ভাই?’
আক্ষেপ করে কথাগুলো বলছিলেন ১১ বছর আগে রানা প্লাজা ধসে পা হারানো গাইবান্ধার সোনিয়া বেগম (২৯)। ২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল ভয়াবহ সেই ঘটনায় গাইবান্ধার ৪৯ জন নিহতের পাশাপাশি আহত হন শতাধিক। নিখোঁজ ১১ জনের এখনো সন্ধান মেলেনি। ঘটনার পর হতাহত ব্যক্তিদের প্রধানমন্ত্রীর অনুদান হিসেবে বিভিন্ন পরিমাণে অর্থসহায়তা দেওয়া হয়। তখন ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের চাকরির প্রতিশ্রুতি দেওয়া হলে পরে বাস্তবায়িত হয়নি। এরপর ১১ বছরে আর সহায়তা মেলেনি।
সোনিয়ার মতো ক্ষতিগ্রস্ত অনেকেই এখনো মানবেতর জীবন যাপন করছেন। সোনিয়ার বাবার বাড়ি সাদুল্লাপুর উপজেলার দামোদরপুর ইউনিয়নের দক্ষিণ দামোদরপুর গ্রামে। ২০১১ সালে একই ইউনিয়নের পূর্ব দামোদরপুর গ্রামের মিজানুর রহমানের সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়। অষ্টম শ্রেণি পাস দম্পতি সুখের আসায় দুই বছর পর ২০১৩ সালে রানা প্লাজার একটি পোশাক কারখানায় চাকরি নেন। চাকরির ২২ দিনের মাথায় মর্মান্তিক সেই ঘটনা ঘটে।
ঘটনার বর্ণনা দিয়ে সোনিয়া বললেন, তিনি সপ্তম তলায় আটকা পড়েছিলেন। কিছু বুঝে ওঠার আগে বিকট শব্দে ভবনটি ধসে পড়ে। দৌড়ে বের হওয়ার সময় বিধ্বস্ত একটি পিলারের নিচে তাঁর ডান পা চাপা পড়ে। তিন দিন পর উদ্ধারকর্মীরা তাঁকে উদ্ধার করেন। হাসপাতালে নিয়ে তাঁর ডান পা কোমরের নিচ থেকে কেটে ফেলা হয়।
আক্ষেপ করে সোনিয়া বলেন, ‘পা হারিয়ে কষ্ট করে চলছি। কিন্তু যাঁদের কারণে পঙ্গু হলাম, এখনো তাঁদের বিচার দেখতে পারছি না। ঘটনার জন্য দায়ী ব্যক্তিদের এমন শাস্তি দেওয়া হোক, যাতে এমন ঘটনা আর দেখতে না হয়। ঘটনার পর সরকার অনেক প্রতিশ্রুতি দেয়। কোনোটাই বাস্তবায়ন করা হয়নি। স্বামীর আয়ে সংসার চলছে না। ধারদেনা করে চলতে হচ্ছে।’
সোনিয়ার স্বামী মিজানুর রহমান রানা প্লাজা ধসের সময় বাইরে থাকায় বেঁচে যান। বর্তমানে নিজের বাড়ির উঠানে মনিহারির দোকান করেন। মাসে তিন থেকে চার হাজার টাকা আয় হয়। ছেলের বয়স আড়াই বছর। মেয়ে মিম্মি তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ে। রানা প্লাজা ধসের পর প্রধানমন্ত্রীর অনুদান হিসেবে সোনিয়া ১০ লাখ টাকা পেয়েছেন। ছেলেমেয়ের ভবিষ্যৎ ভেবে সেই টাকা ব্যাংকে জমা রেখেছেন। মিজানুরের মাসহ তাঁদের পাঁচ সদস্যের সংসার। বসতভিটা ছাড়া কোনো সম্পদ নেই। এমন পরিস্থিতিতে মনিহারির দোকানের আয় দিয়ে তাঁদের সংসার চলছে না।
মিজানুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘ভেবেছিলাম দুজনের চাকরি দিয়ে সংসারে সচ্ছলতা ফিরবে। তা আর হলো না। এখন বাড়িতে ছোট মনিহারির দোকান দিয়েছি। মূলধনের অভাবে সেটিও কখনো কখনো বন্ধ রাখতে হয়। সরকার চাকরি দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিলেও আজ পর্যন্ত তেমন কিছু হয়নি।’
রানা প্লাজা ধসে সাদুল্লাপুরের চকগোবিন্দপুর গ্রামের রিকতা খাতুন (৩০) ডান হাত ও সুন্দরগঞ্জের সাতগিরি গ্রামের লাভলী খাতুন (২৮) বাঁ পা হারান। নিহত হন সাদুল্লাপুর উপজেলার কিশামত হলদিয়া গ্রামের স্মৃতি রানী (২৫) ও দক্ষিণ ভাঙ্গামোড় গ্রামের দিনমজুর ওয়াহেদ আলীর ছেলে সবুজ মিয়া (১৮)। একই গ্রামের আবদুল বারীর মেয়ে বিথী খাতুন (২১) ও সোনা মিয়ার স্ত্রী কামনা খাতুন (২২) ঘটনার পর নিখোঁজ হন। এখনো তাঁদের সন্ধান মেলেনি। প্রতিটি পরিবারই মানবেতর জীবন যাপন করছে।
স্মৃতি রানীর এক স্বজন বলেন, অনুদানের চেক দেওয়ার সময় বলেছিল, পরিবারের একজনকে চাকরি দেবে। কিন্তু চাকরি দূরের কথা, কেউ খোঁজও নেয়নি। সবুজের আত্মীয় বলেন, ‘সরকার পোত্তেক পরিবারোত থ্যাকি এ্যাকজনাক চাকরি দিব্যার চাচিলো। আজও চাকরি দ্যায় নাই।’
২৪ এপ্রিল রানা প্লাজা ধসের ১১ বছর। গাইবান্ধায় হতাহত পরিবারগুলোর পুনর্বাসনে তেমন কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কার্যালয় জানায়, ঘটনার পর প্রধানমন্ত্রীর অনুদান হিসেবে হতাহত ব্যক্তিদের পরিবারকে ১০ থেকে ১২ লাখ টাকা করে দেওয়া হয়। এ ছাড়া কিছু পরিবার পৃথকভাবে সহায়তা পেয়েছিলেন। এরপর আর কোনো সহায়তা মেলেনি। তাঁদের অনেকে এখন কষ্টে দিন যাপন করছেন।
জানতে চাইলে জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা (ভারপ্রাপ্ত) জুয়েল মিয়া প্রথম আলোকে বলেন, রানা প্লাজা ভবন ধসের ঘটনার পরপরই সরকারের পক্ষ থেকে হতাহতের পরিবারগুলোকে আর্থিক সহায়তা দেওয়া হয়েছে। এরপর তাঁদের পুনর্বাসনের বিষয়ে তেমন কোনো সরকারি নির্দেশনা পাওয়া যায়নি।