২৬তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর আয়োজন দেখতে ক্লিক করুন
মূল সাইট দেখতে ক্লিক করুন

২৫০ কোটি টাকার খনন ‘পানিতে’

কুমার নদের ফরিদপুর সদরে ১ হাজার ৮৮৯ জন দখলদারকে চিহ্নিত করা হয়। কিন্তু ৯টি ছাপরাঘর উচ্ছেদ করে পাউবো অভিযান শেষ করে।

শহরের বাসিন্দারা প্রতিদিন যে কুমার নদে গোসল করেন, সেই নদ এখন ভাগাড়ে পরিণত হয়েছে। সম্প্রতি ফরিদপুর শহরের পূর্ব খাবাসপুর এলাকার জোড়া সেতু এলাকায়
ছবি: প্রবীর কান্তি বালা

ফরিদপুর শহরের প্রাণ কুমার নদের দখল-দূষণ কমিয়ে নাব্যতা ফেরাতে পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) ২০১৮ সালে ২৫০ কোটি ৮১ লাখ টাকা ব্যয়ে পুনঃখননের উদ্যোগ নেয়। ৩০ জুন প্রকল্প শেষ হতে যাচ্ছে। এ প্রকল্পের মাধ্যমে নদে ১০ কোটি ঘনমিটার পানি প্রবাহ সৃষ্টির মাধ্যমে ২৩ হাজার ৫৪০ হেক্টর জমিতে সেচসুবিধার লক্ষ্য ধরা হয়েছিল। যার মাধ্যমে প্রতিবছর ৩৪ হাজার ১০৪ মেট্রিক টন অতিরিক্ত ফসল উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রাও ধরা হয়েছিল।

প্রকল্পের শেষ সময়ে এসে দেখা যাচ্ছে, কাজ যথাযথভাবে না হওয়ায় কাঙ্ক্ষিত সুফল মেলেনি। নদের দখল ও দূষণ তো কমেইনি, উল্টো নদের বুকে বর্জ্য ফেলা বেড়েছে। ফেরেনি নাব্যতাও। ফলে আড়াই শ কোটি টাকার পুনঃখননের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য কিছুই অর্জন হয়নি।

জায়গা ছেড়ে দিতে আমাদের আপত্তি নেই, তবে তা সরকারি বিধিবিধান মেনে অধিগ্রহণ করে নিতে হবে। আমার জানামতে, অধিগ্রহণের জন্য ১২ কোটি টাকা রাখা হয়েছিল।
উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি খলিফা কামালউদ্দিন

ফরিদপুর সদরের ডিক্রিরচর ইউনিয়নের মদনখালী এলাকায় পদ্মা নদী থেকে কুমার নদের উৎপত্তি। ফরিদপুর শহর গড়ে উঠেছে এই নদের দুই পারে। ১২১ কিলোমিটার পথ পেরিয়ে গোপালগঞ্জের সেনদিয়া এলাকায় আড়িয়াল খাঁ ও মধুমতি নদীর সংযোগ খাল বিলরুট ক্যানেলে গিয়ে শেষ হয়েছে কুমারের যাত্রাপথ।

পাউবো সূত্রে জানা যায়, ২০১৮ সালে ২১ এপ্রিল কুমার নদ খনন প্রকল্প শুরু হয়। কিন্তু ব্যক্তিমালিকানার জমিসংক্রান্ত বিরোধ নিষ্পত্তি না হওয়ায় উৎসমুখ মদনখালী এলাকার অন্তত ২০০ মিটার অংশে খনন করা যায়নি। ফলে মাতৃনদী পদ্মার সঙ্গে সংযোগ ঘটানো যায়নি।

শহরের বুকে কুমার নদে বাসাবাড়ি ও বাজারের বর্জ্য না ফেলার জন্য আমরা নদের পাড়ে সাইনবোর্ড টাঙিয়ে সবাইকে নিষেধ করে দিয়েছি।
ফরিদপুর পৌরসভার প্যানেল মেয়র মনিরুল ইসলাম

শহরের বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ফরিদপুর শহরে নদের দুই পাড় দখল করে গড়ে উঠেছে নানা স্থাপনা। এসব স্থাপনা অপসারণ করতে না পারায় শহরের বুকে নদ পুনঃখনন করা যায়নি। এ অঞ্চলের বৃহত্তম কাঁচাবাজার হাজী শরীয়তুল্লা বাজার, পাশের তিতুমীর বাজার, ময়ড়াপট্টিসহ যাবতীয় বাজারের আবর্জনা প্রতিনিয়ত ফেলা হচ্ছে নদীর বুকে। কচুরিপানায় পরিপূর্ণ আর ময়লার স্তূপ জমে মজা খালের আকার ধারণ করেছে। পানি পচে দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে।

ফরিদপুর পৌরসভার প্যানেল মেয়র মনিরুল ইসলাম বলেন, ‘শহরের বুকে কুমার নদে বাসাবাড়ি ও বাজারের বর্জ্য না ফেলার জন্য আমরা নদের পাড়ে সাইনবোর্ড টাঙিয়ে সবাইকে নিষেধ করে দিয়েছি। আর শহরের নর্দমার মুখগুলোর বিকল্প পথ খুঁজে বের করার বিষয়ে আমাদের চিন্তাভাবনা রয়েছে।’

রয়েছে প্রভাবশালী দখলদার

ফরিদপুর পাউবোর ২০২০ সালের জরিপে কুমার নদের ফরিদপুর সদরে ১ হাজার ৮৮৯ জন দখলদারকে চিহ্নিত করা হয়। ওই বছর ঢাকঢোল পিটিয়ে উচ্ছেদ অভিযান চালায় পাউবো। শহরের বিসর্জন ঘাট বস্তি এলাকায় ৯টি ছাপরা ঘর উচ্ছেদ করে পাউবো অভিযান শেষ করে।

এ অঞ্চলের বৃহত্তম কাঁচাবাজার হাজী শরীয়তুল্লা বাজার, পাশের তিতুমীর বাজার, ময়ড়াপট্টিসহ যাবতীয় বাজারের আবর্জনা প্রতিনিয়ত ফেলা হচ্ছে নদীর বুকে। কচুরিপানায় পরিপূর্ণ আর ময়লার স্তূপ জমে মজা খালের আকার ধারণ করেছে। পানি পচে দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে।

ফরিদপুর পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলী পার্থ প্রতিম সাহা বলেন, ‘কুমার নদের পাড়ে বিভিন্ন অবকাঠামো থাকায় শহরের মধ্যকার দুই কিলোমিটার পুনঃখনন করা সম্ভব হয়নি। তবে এখানে নাব্যতা রয়েছে। কাটতে পারলে প্রশস্ততা বাড়ানো যেত। তবে কিছুদিন আগে শহরের পশ্চিম খাবাসপুর এলাকার কুমার নদের ভাঙন দেখে আমরাও আর কাটতে সাহসী হইনি।’

অবৈধ দখলদারদের উচ্ছেদ কেন করা গেল না জানতে চাইলে পার্থ প্রতিম সাহা বলেন, ‘উচ্ছেদের উদ্যোগ যখন নেওয়া হয়, তখন আমি ফরিদপুর ছিলাম না। ওই সময়ে কেন এ কাজটি এগিয়ে নেওয়া হলো না, সে বিষয়ে কোনো তথ্য আমার জানা নেই।’

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, মদনখালী এলাকার ২০০ মিটার অংশে দেড় থেকে দুই একর জমি রয়েছে। এ জমির মালিক সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি খলিফা কামালউদ্দিন ও এলাকার বাসিন্দা পান্নু মিয়া। তাঁদের বিরোধিতার জন্যই পদ্মার সঙ্গে কুমারের সংযোগ ঘটানো যাচ্ছে না।

বর্তমানে নদটি কচুরিপনায় পরিপূর্ণ হয়ে আছে। এ অবস্থায় ১৭ জুন কচুরিপানা পরিষ্কার করা শুরু হবে।
জেলা প্রশাসক মো. কামরুল আহসান তালুকদার

খলিফা কামালউদ্দিন বলেন, ‘জায়গা ছেড়ে দিতে আমাদের আপত্তি নেই, তবে তা সরকারি বিধিবিধান মেনে অধিগ্রহণ করে নিতে হবে। আমার জানামতে, অধিগ্রহণের জন্য ১২ কোটি টাকা রাখা হয়েছিল। পাউবো জমি অধিগ্রহণের উদ্যোগ না নিয়ে সে টাকা ফেরত পাঠিয়েছে।’

জেলা প্রশাসক মো. কামরুল আহসান তালুকদার বলেন, বর্তমানে নদটি কচুরিপনায় পরিপূর্ণ হয়ে আছে। এ অবস্থায় ১৭ জুন কচুরিপানা পরিষ্কার করা শুরু হবে।

ফরিদপুর সচেতন নাগরিক কমিটির (সনাক) সভাপতি আওলাদ হোসেন বলেন, ফরিদপুর শহরকে টিকিয়ে রাখতে হলে কুমার নদকে বাঁচিয়ে তুলতে হবে। এ জন্য দ্রুত কার্যকরী ব্যবস্থা নেওয়া হবে—এমনটিই দাবি জনগণের।