হাজারো পাখির কিচিরমিচির শব্দে ঘুম ভাঙে যে গ্রামের মানুষের
আকাশে ঝাঁকে ঝাঁকে শামুকখোল, পানকৌড়িসহ নাম না–জানা পরিযায়ী পাখির ওড়াউড়ি। নিচে জবই বিল। পানিতে টুপটাপ ডুব দিচ্ছে কত শত পাখি। বিলের চারপাশে ফসলের মাঠ ও গ্রাম। শর্ষে, গমসহ ফসলের খেত ও গ্রামের গাছে গাছে পাখিরা ওড়াউড়ি করছে।
নওগাঁ শহর থেকে ৭০ কিলোমিটার দূরে সাপাহার উপজেলার শিরন্টি, আইহাই ও পাতাড়ী ইউনিয়নে ঐতিহ্যবাহী জবই বিলের দৃশ্য এটি। এক দশকের বেশি সময় ধরে সাইবেরিয়া অঞ্চলসহ বিশ্বের শীতপ্রধান নানা দেশ থেকে এই বিলে পাখি আসা শুরু করে। ইতিমধ্যে বিলটিকে পাখিদের অভয়াশ্রম ঘোষণা করা হয়েছে। শীত ও বসন্তে সকাল-সন্ধ্যা পাখিদের কলকাকলিতে মুখর থাকে বিলের চারপাশ। পাখির কিচিরমিচির শব্দে ঘুম ভাঙে বিলের আশপাশের গ্রামের বাসিন্দাদের। পাখি দেখতে প্রতিদিন দূরদূরান্ত থেকে ছুটে আসেন দর্শনার্থীরা।
গতবারের চেয়ে এবার পাখির আনাগোনা বেশি মনে হচ্ছে। বিলের আশপাশে ১০ গ্রামের মানুষের এখন পাখির কিচিরমিচির শব্দ শুনে সকালে ঘুম ভাঙে। পাখি দেখতে প্রতিদিনই শহর থেকে দলে দলে লোকজন আসেন।
জবই বিলের পশ্চিমে কলমুডাঙ্গা গ্রাম। বাসিন্দা জয়নাল আবেদিনের ভাষ্য, এবার নভেম্বরের মাঝামাঝি সময় থেকে পাতি সরালি, বালিহাঁস, শামুকখোল, পানকৌড়িসহ নাম না–জানা শত শত পাখি আসতে শুরু করে। গতবারের চেয়ে এবার পাখির আনাগোনা বেশি মনে হচ্ছে। বিলের আশপাশে ১০ গ্রামের মানুষের এখন পাখির কিচিরমিচির শব্দ শুনে সকালে ঘুম ভাঙে। পাখি দেখতে প্রতিদিনই শহর থেকে দলে দলে লোকজন আসেন।
বিলের আশপাশের বাসিন্দারা জানান, প্রতিবছর শীতের সময় বিলে পাখিদের বিচরণ বেড়ে যায়। নভেম্বর মাসের শেষ সপ্তাহ থেকে পরিযায়ী পাখির আনাগোনা বাড়তে শুরু করে। তবে এবার নভেম্বরের ১৪-১৫ তারিখ থেকে বিলে পাখি আসা শুরু করে। ফেব্রুয়ারি-মার্চ পর্যন্ত পরিযায়ী পাখির বিচরণ থাকে। জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি মাসে সবচেয়ে বেশি পাখির বিচরণ দেখা যায়।
এক দশকের বেশি সময় ধরে সাইবেরিয়া অঞ্চলসহ বিশ্বের শীতপ্রধান নানা দেশ থেকে এই বিলে পাখি আসা শুরু করে। ইতিমধ্যে বিলটিকে পাখিদের অভয়াশ্রম ঘোষণা করা হয়েছে। শীত ও বসন্তে সকাল-সন্ধ্যা পাখিদের কলকাকলিতে মুখর থাকে বিলের চারপাশ।
গত সোমবার বিকেলে জবই বিলে গিয়ে প্রথম দেখায় বিলটিকে হাঁসের খামার মনে হয়। কাছে যেতেই ভুল ভাঙে। মানুষের উপস্থিতি টের পেয়েই উড়াল দেয় পাখিগুলো। স্থানীয় লোকজন এসব পাখিকে বালিহাঁস, সরালি ও পাতি সরালি বলে ডাকেন। পরিযায়ী পাখি ছাড়াও বিলে শামুকখোল, পানকৌড়ি, ছন্নিহাঁস ও বকের দেখা মিলল।
বিলের পূর্বে জবই গ্রামের সাইফুল ইসলাম বলেন, পাখিরা জলাশয় ছাড়াও গ্রামের গাছপালা, বাড়ির ছাদসহ বিভিন্ন জায়গায় ওড়াউড়ি করে। গাছের ফল খেয়ে ফেলে। বাসাবাড়ির টিনের চালা, ছাদ ও আঙিনা নোংরা করে। এরপরও গ্রামের মানুষ পাখিদের কোনো সমস্যা করেন না।
বিলের ভেতর দিয়ে একটি সড়ক চলে গেছে। সড়কের দুই পাশে দর্শনার্থীদের বসার জন্য প্রশাসনের পক্ষ থেকে কংক্রিটের বেঞ্চ তৈরি করে দেওয়া হয়েছে। সড়কে হাঁটতে হাঁটতে পাখি দেখছিলেন বিভিন্ন স্থান থেকে আসা দর্শনার্থীরা। পত্নীতলার নজিপুর পৌরসভা থেকে মা-বাবা ও ভাইয়ের সঙ্গে পাখি দেখতে এসেছেন সাদিয়া আক্তার (২০)। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, নিজেদের এলাকায় পরিযায়ী পাখির অভয়াশ্রম দেখে খুব ভালো লাগছে। লাল ঝুঁটিওয়ালা হাঁস এই প্রথম দেখলাম। পাখিদের এমন কলকাকলি দেখে সত্যিই মনটা ভালো হয়ে গেল।
দর্শনার্থীদের কেউ সাপাহার উপজেলা সদর থেকে জবই বিলে যেতে চাইলে ১২ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিতে হবে। উপজেলার শিরন্টি ইউনিয়ন বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তঘেঁষা। বিলের উত্তর অংশে ভারত সীমান্ত। বর্ষায় জবই বিলের আয়তন প্রায় ২ হাজার হেক্টর হয়। শুষ্ক মৌসুমে প্রায় ৮০০ হেক্টর এলাকাজুড়ে পানি থাকে। সরকারি হিসাব অনুযায়ী, বিলে খাসজমির পরিমাণ ৪০৩ হেক্টর। মূলত ডুমরইল, বোরা মির্জাপুর, মাইল, ভুতকুড়ি ও কালিন্দার বিলের সমন্বয়ে জবই বিল।
দেড় দশক আগে ‘জবই বিল জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ ও সমাজকল্যাণ’ নামে একটি সংস্থা গড়ে তোলেন স্থানীয় কয়েকটি গ্রামের তরুণেরা। কেউ যাতে পাখি শিকার করতে না পারেন, সেদিকে নজর রাখেন সংস্থাটির সদস্যরা। প্রতিবছর সংস্থাটির পক্ষ থেকে জবই বিলে পাখি জরিপ করা হয়। সর্বশেষ জরিপ অনুযায়ী, গত বছর জবই বিলে দেশি ও পরিযায়ী মিলে ৩২ ধরনের ৬ হাজার ৬৯২টি পাখির আগমন ঘটেছিল। এবার জানুয়ারি থেকে এপ্রিল ও ১ নভেম্বর থেকে ৮ ডিসেম্বর পর্যন্ত মোট পাখি এসেছে ১১ হাজার ২৩০টি। ৩২ ধরনের পাখির মধ্যে পাতি সরালি, লাল ঝুঁটি-ভূতি হাঁস, শামুকখোল ও পানকৌড়ি পাখির সংখ্যাই বেশি।
জবই বিল জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ সংস্থার সভাপতি সোহানুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, গতবারের চেয়ে এবার বিলে পাখির বিচরণ বেশি। বিলে ছোট মাছ বেশি থাকায় পাখিরা খাবার পাচ্ছে বেশি। এ ছাড়া জবই বিলের পূর্ব পাশে খালের দুই ধারে তাঁদের সংস্থার পক্ষ থেকে গাছ লাগানো হয়েছে। এতে পাখিরা গাছে অবস্থান নিতে পারছে। এ জন্য পাখি বেশি মনে হচ্ছে। তবে বিলে বেশি বেশি মাছ আহরণ, অনিয়ন্ত্রিত ইঞ্জিনচালিত নৌকার চলাচলসহ নানা কারণে বিলের জীববৈচিত্র্য হুমকিতে পড়ছে।