গ্রামীণ নানা খেলায় কপোতাক্ষ পাড়ে ঈদ আনন্দ
কপোতাক্ষ নদের চর ঘিরে মাঠের চারদিকে দর্শকদের উল্লাস। মাঝখানে একদল শিশু একে অপরের হাত ধরে দাঁড়িয়ে আছে। মাইকে একজন বলছেন, ‘পাখি উড়ে, চিল উড়ে, চড়ুই উড়ে, কবুতর উড়ে।’ শিশুরাও দুই হাত পাখি ওড়ার মতো করে দোলাচ্ছে। ঘোষক হঠাৎ মাইকে বলে উঠলেন, ‘হাতি উড়ে, ঘোড়া উড়ে, গরু উড়ে।’ তখন অধিকাংশ হাত না দুলিয়ে দাঁড়িয়ে থাকলেও কয়েকজন তাল সামলাতে না পেরে পাখির ওড়ার ভঙ্গিতে হাত দুলিয়ে ফেলে। এরপর তারা খেলা থেকে বাদ পড়ে যায়। সঙ্গে সঙ্গে আনন্দে করতালি দিচ্ছেন দর্শকেরা। এভাবে শেষ পর্যন্ত যে টিকে থাকবে সে-ই হবে বিজয়ী।
খেলাটির নাম ‘শিশুদের হাতি উড়ে’। আজ মঙ্গলবার সকাল ১০টার দিকে খুলনার কয়রা উপজেলার কপোতাক্ষ নদের পাড়ে গোবরা গ্রামে এমন দৃশ্য দেখা গেল। বিভিন্ন বয়সী মানুষের সঙ্গে ঈদের আনন্দ ভাগাভাগি করে নিতে গ্রামীণ খেলাধুলার আয়োজন করে ‘বন্ধন তরুণ সংঘ’ নামের একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন। গ্রামবাংলার ঐতিহ্যবাহী খেলা দেখতে কপোতাক্ষ পাড়ে ঢল নামে নানা বয়সী মানুষের।
মাঠের আরেক পাশে হাত ও পায়ে ভর দিয়ে শরীর উঁচু রেখে পিলপিল করে একদল শিশুকে চলতে দেখা গেল। কাছে গিয়ে জানা গেল, প্রতিযোগিতার নাম ‘কাঁকড়া দৌড়’। এসব প্রতিযোগিতার পাশাপাশি বিভিন্ন বয়সী মানুষের জন্য কাছি টানাটানি, দড়িলাফ, উচ্চ লাফ, বাজনার তালে তালে আসন গ্রহণ, বালতিতে বল নিক্ষেপ, ৪০ বছরের বেশি বয়সীদের নিয়ে ফুটবল খেলাসহ বিভিন্ন ধরনের গ্রামীণ খেলার আয়োজন করা হয়।
মাঠে খেলা দেখতে আসা গোবরা গ্রামের বাসিন্দা আব্দুল মান্নান মিস্ত্রি বলেন, ঈদের পরদিন গ্রামের মানুষকে বিনোদন দিতে এমন আয়োজন সত্যিই প্রশংসার দাবি রাখে। খেলা দেখে তিনি অনেক আনন্দ পেয়েছেন। বিশেষ করে দড়ি টানাটানি খেলা বেশ উপভোগ্য ছিল। খেলার ব্যাপারে আবদুল মান্নান বলেন, ‘খেলাটি মূলত শক্তি পরীক্ষার। পেশিশক্তির পাশাপাশি প্রচণ্ড বল প্রয়োগের প্রয়োজন হয়। গ্রামের মানুষ দুই দলে ভাগ হয়ে মোটা ও লম্বা একটি দড়ির দুই দিকে শক্ত মুঠোয় ধরে নিজেদের দিকে টানতে থাকে। মাঝখানে দাগ দেওয়া থাকে। টেনে এনে প্রতিপক্ষকে সেই দাগ পার করতে পারলেই জয়।’
কপোতাক্ষ পাড়ের ঈদ উৎসব ও ক্রীড়া প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠানে অতিথি হিসেবে ছিলেন যুগ্ম জেলা ও দায়রা জজ ও স্থানীয় বাসিন্দা মো’তাছিম বিল্যাহ, জনতা ব্যাংক খুলনার দৌলতপুর শাখার ব্যবস্থাপক মো. জাহাঙ্গীর আলম, একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপক মো. রবিউল ইসলাম প্রমুখ।
আয়োজক সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক আনোয়ার হুসাইন বলেন, বাংলার ঐতিহ্যবাহী খেলা সবার মধ্যে ছড়িয়ে দিতে এমন আয়োজন। এলাকাবাসী আশাতীত সাড়া দিয়েছেন। ভবিষ্যতে এমন উৎসব আরও বেশি করে আয়োজন করা হবে। কপোতাক্ষ নদের পাড় ছাড়াও এলাকার বিভিন্ন জায়গায় এমন খেলাধুলার আয়োজন করা হয়েছে।
আনোয়ারের কথার সূত্র ধরে কপোতাক্ষ পাড় থেকে কয়রার ঘাটাখালী এলাকায় গিয়ে একই ধরনের আয়োজন দেখা গেল। সুন্দরবন যুব সংঘ নামের স্থানীয় একটি সংগঠন ঘাটাখালী এলাকায় নানা খেলার আয়োজন করে।
মাঠের এক পাশে গিয়ে দেখা গেল, দড়িতে বিস্কুট ঝুলছে। একটু দূরে সারি ধরে দাঁড়িয়ে আছে শিশুরা। সবার হাত পেছনে। একজন বাঁশিতে ফুঁ দিতেই শিশুরা দৌড়ে বিস্কুটের কাছে এসে মুখ দিয়ে বিস্কুট নিয়ে ফিরে যাওয়ার চেষ্টা। ঝুলন্ত বিস্কুট মুখে নিতে ঘাম ছুটে যাচ্ছে। যে সবার আগে বিস্কুট নিয়ে গন্তব্যে পৌঁছাবে, সে-ই বিজয়ী। মাঠের আরেক পাশে চলছে ‘মোরগ লড়াই’। সেখানে শিশু-কিশোর, যুবক-প্রবীণসহ নানা বয়সীদের জন্য ২২ ধরনের খেলার আয়োজন করা হয়েছে।
আয়োজক সংগঠনের সভাপতি সরদার বিল্লাল হোসেন বলেন, নতুন প্রজন্ম সারা দিন হাতে মুঠোফোন নিয়ে ব্যস্ত থাকে। গ্রামে খেলাধুলা একেবারে হয় না বললেই চলে। আগের খেলাগুলো নতুন প্রজন্মের কাছে তুলে ধরতে এমন আয়োজন। কাল বুধবারও খেলাধুলা চলবে। এরপর বিজয়ীদের পুরস্কার দেওয়া হবে।
খেলা দেখতে আসা ঘাটাখালী এলাকার বাসিন্দা ও অবসরপ্রাপ্ত সহকারী শিক্ষা কর্মকর্তা শেখ মোবারক আলী বলেন, একসময় গ্রামগঞ্জে নিয়মিতই এমন আয়োজন হতো। আধুনিকতার ছোঁয়ায় এসব ঐতিহ্য হারিয়ে যেতে বসেছে। এমন আয়োজন হলে পরিবার-পরিজন নিয়ে খেলা উপভোগ করার সুযোগ হয়। তরুণ-তরুণীদেরও খেলায় অংশ নেওয়ার আগ্রহ তৈরি হয়। মুঠোফোনের আসক্তি দূর করতে এমন খেলার আয়োজন বারবার দরকার।