পিরোজপুরে চাঁদাবাজির মামলায় বিলুপ্ত জাতীয় নাগরিক কমিটির নেতা গ্রেপ্তার
পিরোজপুরে চাঁদাবাজি, ভাঙচুর ও লুটপাটের মামলায় সদ্য বিলুপ্ত জাতীয় নাগরিক কমিটির সদর উপজেলা প্রতিনিধি কমিটির ১ নং সদস্য ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সাবেক জেলা সমন্বয়ক মুসাব্বির মাহমুদকে (সানি) গ্রেপ্তার করা হয়েছে। আজ শনিবার বেলা দুইটার দিকে শহরের ব্র্যাক ব্যাংকের সামনে থেকে তাঁকে গ্রেপ্তার করে সদর থানা-পুলিশ। অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. মুকিত হাসান বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
মুকিত হাসান বলেন, গতকাল শুক্রবার পিরোজপুর শহরের শহীদ ওমর ফারুক সড়কে নির্মাণাধীন মডেল মসজিদের নিয়োজিত ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের অস্থায়ী কার্যালয়ে ভাঙচুরের ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় মুসাব্বিরসহ তিনজনের নাম উল্লেখ ও ২০-২৫ জনকে অজ্ঞাতনামা আসামি করে একটি মামলা করেন ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপক শহিদুল ইসলাম। এ মামলায় মুসাব্বিরকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। বাকিদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, মডেল মসজিদ নির্মাণ প্রকল্পটির ঠিকাদার পিরোজপুর পৌরসভার সাবেক মেয়র হাবিবুর রহমান ওরফে মালেক। তিনি পিরোজপুর জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি।
প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা অভিযোগ করেন, শুক্রবার দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে মুসাব্বিরের নেতৃত্বে ২৫ থেকে ৩০ জন শহীদ ওমর ফারুক সড়কে নির্মাণাধীন মডেল মসজিদের পাশে ঠিকাদারের কার্যালয়ে হামলা করেন। এ সময় তাঁরা কার্যালয়ে ঢুকে ভাঙচুর করেন এবং শ্রমিকদের মজুরি দেওয়ার জন্য রাখা ৫ লাখ টাকা লুট করে নিয়ে যান। এ ঘটনায় আজ শনিবার সকালে পিরোজপুর সদর থানায় প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপক শহিদুল ইসলাম বাদী হয়ে মামলা করেন।
এদিকে শুক্রবার দুপুরে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানে হামলার পর বেলা সাড়ে তিনটার দিকে মুসাব্বিরের নেতৃত্বে আটটি মোটরসাইকেলে ২০-২২ জন যুবক বলেশ্বর নদের সেতুর টোল প্লাজায় হামলা চালান এবং টোলঘরে আগুন দেন। এ সময় টোলের অর্থ লুট করেন বলেও অভিযোগ।
টোল প্লাজার ব্যবস্থাপক আবুল হোসেন অভিযোগ করেন, বেলা সাড়ে তিনটার দিকে মুসাব্বিরের নেতৃত্বে মোটরসাইকেল আসা যুবকেরা প্রথমে তাঁদের মারধর করেন। এরপর টোল আদায়ের ঘরে আগুন দেন। পরে তাঁরা টোল প্লাজার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে রাত ৯টা পর্যন্ত সেতু পারাপারকারী যানবাহনগুলোর টোল আদায় করেন। এই সেতুর বৈধ ইজাদারও সাবেক পৌর মেয়র হাবিবুর রহমান।
আবুল হোসেন বলেন, এর আগে গত ৫ আগস্ট ও পরবর্তী সময়ে পৌর মেয়র হাবিবুর রহমানের বাড়িতে ও তাঁর পেট্রলপাম্পে মুসাব্বির তাঁর লোকজন নিয়ে অগ্নিসংযোগ করেন ও লুটপাট চালান।
মুসাব্বিরের বিরুদ্ধে যত অভিযোগ
গত ৫ ফেব্রুয়ারি পিরোজপুর জেলা যুবলীগের সভাপতি আখতারুজ্জামানের (ফুলু) গ্রামের বাড়িতে মুসাব্বির নিজে দাঁড়িয়ে অগ্নিসংযোগ করেন। এতে পুরো বাড়ি ভস্মীভূত হয়। আখতারুজ্জামানের ছেলে অনীক বলেন, ‘গত ৫ ফেব্রুয়ারি রাত ৯টার দিকে আমার দাদার বাড়িতে সানি তাঁর দলবল নিয়ে ঢুকে আমার মাকে ঘর থেকে বের দেয়। এরপর আমার মায়ের সামনে ঘরে আগুন ধরিয়ে দেয়। আগুন ধরানোর আগে তারা আমাদের ঘরে লুটপাটও করে। সে নিজেকে সমন্বয়ক পরিচয় দিয়ে এসব ঘটনা ঘটাচ্ছে, আমরা কার কাছে বিচার চাইব?’
মুসাব্বির তাঁর লোকজন নিয়ে ৫ আগস্ট ও এর পরে কয়েকবার সাবেক মন্ত্রী ও সংসদ সদস্য শ ম রেজাউল করিমের বাড়ি, সাবেক উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান এস এম বাইজিদ হোসেনের বাড়ি, সাবেক সংসদ সদস্য আউয়ালসহ আওয়ামী লীগের বিভিন্ন নেতা ও ব্যবসায়ীর বাড়িতে ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাট করেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
এ ছাড়া গত ২৮ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) আত্মপ্রকাশ অনুষ্ঠানে নেতা-কর্মীদের আনার জন্য পিরোজপুর জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে পাঁচটি বাস রিকুইজিশন দেওয়া হয়। সারা দেশে এ ঘটনায় আলোচনা-সমালোচনা তৈরি হয়। তখন মুসাব্বির মাহমুদের চাপে পিরোজপুর জেলা প্রশাসন বাস রিকুইজিশন দিতে বাধ্য হয় বলে অভিযোগ ওঠে।
পিরোজপুর জেলা বিএনপির আহ্বায়ক আলমগীর হোসেন বলেন, ‘পিরোজপুরের বেশ কিছু ছেলে নিজেদের সমন্বয়ক পরিচয় দিয়ে বিভিন্ন বিভিন্ন ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে অগ্নিসংযোগ-ভাঙচুর চালাচ্ছে। তবে যারা এ ধরনের ঘটনা ঘটাচ্ছে, তার আগে ছাত্রলীগ করত। এখন নিজেদের সমন্বয়ক পরিচয় দিয়ে চলে। তাদের দ্রুত আইনের আওতায় আনার জন্য প্রশাসনকে দাবি জানাই।’
পিরোজপুর বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ছাত্রপ্রতিনিধি শাহনাজ অভি বলেন, ‘৫ আগস্টের আগে সানি ছাত্রলীগের কর্মী ছিল। আগস্ট মাসের পর থেকে সে নিজেকে সমন্বয়ক পরিচয় দিয়ে বিভিন্ন ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান থেকে চাঁদা আদায় শুরু করে। ব্যবসায়ীরা চাঁদা দিতে অস্বীকৃতি জানালে তার দলবল নিয়ে সেই প্রতিষ্ঠানে আগুন দিয়ে দেয়। আমাদের সঙ্গে তার আর কোনো সম্পর্ক নেই। সে কয়েকবার আমাদের ওপরেও হামলা করেছে।’
তবে গ্রেপ্তারের আগে এসব অভিযোগ অস্বীকার করে মুসাব্বির মাহমুদ বলেন, ‘এগুলো সম্পূর্ণ মিথ্যা কথা। আমার বিরুদ্ধে একটি পক্ষ এ ধরনের অপপ্রচার করছে। শুক্রবারের ঘটনা হলো, হাইকোর্টের রায়ে কাজ বন্ধ করার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু তাঁরা অবৈধভাবে টাকাপয়সা খেয়ে কাজ করাইতেছেন। বিক্ষুব্ধ জনতা এসে ভাঙছে, এতে আমার নাম বলার কী আছে? এটা মালেক মিয়ার (হাবিবুর রহমান) কাজ। আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের দাবিতে বিক্ষোভ মিছিল হইছে। ওইখান থেকে ছাত্রজনতা গেছে। এখন যদি আওয়ামী লীগ পুনর্বাসন করতে চায়, এটা তো কষ্টের ব্যাপার। আমরা রক্ত দিয়ে দেশ স্বাধীন করছি, এখন আওয়ামী লীগকে পুনর্বাসন করতে দেব না। আমরা তো আর টাকায় বিক্রি হবে না। কাজের আবার রি-টেন্ডার হবে। মালেক মিয়ার লাইসেন্সে কাজ হইতে দেব না।’