নওগাঁর শতবর্ষী ‘প্রেমতলীর মেলা’
নওগাঁর নিয়ামতপুর উপজেলার গুজিশহর গ্রামে শনিবার শুরু হয়েছে ঐতিহ্যবাহী ‘প্রেম গোসাই মেলা’। মাসব্যাপী চলা গ্রামীণ মেলাটি স্থানীয় বাসিন্দাদের কাছে ‘প্রেমতলীর মেলা’ নামেও পরিচিত। মেলাটি বসছে ১০০ বছরের বেশি সময় ধরে। আশপাশের নানা জায়গা থেকে মেলায় ভিড় করে মানুষ।
মেলায় চাঁপাইনবাবগঞ্জের গোমস্তাপুর উপজেলার সহরপুর গ্রাম থেকে কাঠের তৈরি খেলনা নিয়ে এসেছেন জুলফিকার আলী। তিনি বলেন, বাবা-দাদার সময় থেকে এই মেলায় কাঠের খেলনা বিক্রি করে আসছেন তাঁরা। প্রতিদিনই দূরদূরান্ত থেকে লোকজন এই মেলায় আসে। বেচাকেনা খুব ভালো হয়।
দুপুরে মেলায় গিয়ে দেখা গেল, পণ্যের পসরা সাজিয়ে বসেছেন দূরদূরান্ত থেকে আসা ব্যবসায়ীরা। মিষ্টি, খেলনা, চুড়ি, ফিতা, আলতা থেকে গৃহস্থালির নানা জিনিস বিক্রি হচ্ছে এখানে। মিষ্টি, জিলাপি বানানো হচ্ছে হচ্ছে ৫০টির বেশি দোকানে। বিক্রিও হচ্ছে বেশ। সকাল থেকেই চলছে নাগরদোলা। চলবে সন্ধ্যা পর্যন্ত।
মেলায় এসেছেন নওগাঁর মান্দা উপজেলার কুসুম্বা গ্রামের মাহফুজ আলম। তিনি বলেন, ‘ঐতিহ্য ধরে রেখেছে নিয়ামতপুরের গুজিশহরের মেলাটি। এখন গ্রামগঞ্জেও আধুনিক সব পণ্যের দোকানপাট গড়ে উঠেছে। তারপরও কাঠের আসবাবসহ গৃহস্থালির প্রয়োজনীয় পণ্য কিনতে মানুষ এই মেলায় আসে। মাসব্যাপী এই মেলায় প্রতিবারই আসি। প্রথম দিন মেলায় এসেছি কেমন দোকানপাট বসেছে তা দেখতে। পরে আরেক দিন এসে দরকারি জিনিসপত্র কিনব। আজকে ছেলেমেয়েদের জন্য কিছু মিষ্টি কিনে নিয়ে বাড়ি ফিরব।’
প্রতিবছর গুজিশহর উচ্চবিদ্যালয়–সংলগ্ন ফাঁকা জায়গায় মূল মেলার আয়োজন করা হয়। তবে মেলা শুধু মেলা প্রাঙ্গণেই সীমিত থাকেনি। আমন ধান কেটে নেওয়ার পর ফাঁকা পড়ে থাকা কৃষিজমির মাঠেও বসেছে মেলার বিভিন্ন দোকানপাট।
চিত্তবিনোদনের জন্য বসানো হয়েছে সার্কাসের প্যান্ডেল। এ ছাড়া শিশু-কিশোরদের আনন্দ-বিনোদনের জন্য একাধিক নাগরদোলা ও রাইড বসানো হয়েছে।
এই মেলা ঘিরে জামাতা ও আত্মীয়স্বজনকে আমন্ত্রণ করে আপ্যায়ন করার রেওয়াজ রয়েছে স্থানীয় বাসিন্দাদের মধ্যে। বাড়িতে বাড়িতে বানানো হয় বাহারি পিঠা। মেলা থেকে মিষ্টি কিনে এনে মেয়ে, জামাতা ও আত্মীয়স্বজনদের খাওয়ানোর রেওয়াজ ধরে রেখেছে এলাকাবাসী।
গুজিশহর গ্রামের বাসিন্দা জুলেখা বিবি (৭০) বলেন, ‘হামাগের জন্মের পর থ্যাকে এই মেলা দেখে আসোছি। হামাগের বাপ-দাদারাও কতে পারেনি কবে থেকে এই মেলা শুরু হছে। আগে এই মেলায় মাটির তৈরি বাসনকোসন পাওয়া য্যাত। এখনো মাটির তৈরি বাসনকোসন লিয়ে কিছু কিছু দোকান বসে, কিন্তু আগের মতো লয়। মাটির হাঁড়ি-পাতিল ঝোলানোর জন্য পাটের তৈরি শিকি পওয়া য্যাত আগে। সেই শিকি অ্যাখন আর পাওয়া যায় না।’
মেলা নিয়ে প্রচলিত গল্পটি বলেন স্থানীয় বাসিন্দা প্রবীণ মহেন্দ্রনাথ বর্মণ। তিনি বলেন, ‘গুজিশহর উচ্চবিদ্যালয়ের পাশে একটি শতবর্ষী বটগাছ আছে। শত বছর আগে সেই গাছের তলায় একজন ঠাকুর বসতেন। তিনি অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন। তাঁর কাছে মানুষ এসে কোনো প্রার্থনা করলে সেটা পূরণ হতো। সেখান থেকে এই মেলা শুরু।’
মেলার আয়োজক কমিটির সদস্যসচিব ও গুজিশহর উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক নুরুল ইসলাম বলেন, প্রতিবছর পৌষসংক্রান্তির দিনে মেলাটি বসে। চলে এক মাস ধরে। এ জন্য আগাম কোনো ঘোষণা দেওয়া হয় না। ১০০ বছরের বেশি সময় ধরে একই দিনে মেলাটি বসছে। দূরদূরান্তের মানুষ এখনো আসে মেলায় যোগ দিতে। সে কারণে সব ধরনের সুবিধা রাখতে আয়োজক কমিটি প্রায় এক মাস আগে সব প্রস্তুতি নিয়ে থাকে। এবারও সে রকম প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। মেলার নিরাপত্তার জন্য সারা দিন পুলিশ মোতায়েন থাকবে। এই মেলা থেকে প্রাপ্ত অর্থ দিয়ে গুজিশহর মসজিদ, মন্দির, প্রাথমিক বিদ্যালয় ও হাইস্কুলের উন্নয়ন করা হয়। এসব প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা বিনা বেতনে পড়ার সুযোগ পেয়ে থাকে।