শেষবারের মতো প্রকৌশল পড়ুয়া ছেলের মুখ দেখা হলো না মায়ের

কিশোরগঞ্জের হাওড়ে ডুবে মারা যাওয়া আবিদুর রহমান

বাড়িতে লোকজনের ভিড়। আত্মীয়স্বজন-পাড়াপ্রতিবেশীরা এসেছেন সান্ত্বনা দিতে। তাঁদের প্রায় সবাইকে ধরে ধরে ছেলের কথা বলে বুক চাপড়াচ্ছিলেন তাহমিনা নুর। ছেলে আবিদুর রহমানের (২৪) সব স্মৃতি যেন তাঁর সামনে খোলা বইয়ের মতো রাখা। একটা করে সেই বইয়ের পাতা ওলটাচ্ছিলেন আর কান্নায় ভেঙে পড়ছিলেন তিনি। এমন সময় লাশ নিয়ে আসা অ্যাম্বুলেন্সের সাইরেনের শব্দ শোনা যায়। তখনই জ্ঞান হারান তাহমিনা।

এরপর স্বজনেরা ধরাধরি করে তাঁকে নিয়ে যান শোবার ঘরে। ছেলেকে আনা হলেও শোকাতুর মা তাঁকে দেখতে পারেননি। বারবার মূর্ছা যাচ্ছিলেন তিনি। ছেলের নিথর দেহ বহন করে আনা লাশবাহী ফ্রিজার গাড়ি কেবল দূর থেকে দেখেছেন তিনি।

আজ রোববার সকাল সাড়ে নয়টায় কিশোরগঞ্জ থেকে আবিদুরের লাশ এসে পৌঁছায় রাউজানের গহিরার মোবারকখিল গ্রামের বাড়িতে। প্রতিবার বিদায় নেওয়ার আগে হাসিখুশি আবিদুর মায়ের সঙ্গে কত কথাই না বলতেন। আজও শেষ বিদায় নেওয়ার জন্য বাড়ির সামনে এসেছেন তিনি। তবে পার্থক্য আজ বাড়িতে ঢোকেননি তিনি। ছিলেন বাইরে দাঁড়ানো ফ্রিজার গাড়িতে।

আবিদুরকে শেষ বিদায় জানাতে গ্রামের শত শত নারী-পুরুষ ভিড় করেছিলেন। খুব ভদ্র-নম্র স্বভাবের ছিলেন তিনি। লেখাপড়ায়ও ছিলেন ভালো। এমন ছেলেকে নিয়ে গর্ব করতেন মা-বাবা, স্বজন আর প্রতিবেশীরাও।

ঢাকার উত্তরার ইউনিভার্সিটি অব ফ্যাশন অ্যান্ড টেকনোলজির পঞ্চম সেমিস্টারের শিক্ষার্থী আবিদুর রহমান ছিলেন চট্টগ্রাম সরকারি টিচার্স ট্রেনিং কলেজের সহযোগী অধ্যাপক সারোয়ার জামান খানের দুই ছেলে এক মেয়ের মধ্যে দ্বিতীয়। আজ সকাল সাড়ে ১০টায় মোবারকখিল গ্রামের মসজিদের মাঠে জানাজা শেষে তাঁকে পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয়।

আবিদুরের বন্ধুদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গত বৃহস্পতিবার বিকেলে ৯ জন সহপাঠীসহ আবিদুর ঢাকা থেকে কিশোরগঞ্জের করিমগঞ্জের এক বন্ধুর বাসায় ওঠেন। সেখানে রাতযাপন শেষে বিকেলে হাওরের উদ্দেশে বের হন। সাড়ে পাঁচটার দিকে তাঁরা একটি বোটে করে পৌঁছান হাসানপুর সেতু এলাকায়। সেখানে তাঁরা ৯ সহপাঠী নেমে গোসল সারেন। হঠাৎ ৫ থেকে ৭ ফুট দূরে স্রোতে আটকে যান আবিদুর। সাঁতার না জানা বন্ধুরা মিলে একজন আরেকজনের হাত ধরে বন্ধনী তৈরি করে সাঁতার জানা আবিদুরকে উদ্ধারের চেষ্টা চালান। কিন্তু পেরে ওঠেননি। ধীরে ধীরে তিনি তলিয়ে যান। সাহায্যের জন্য বন্ধুরা সবখানে খবর দেন। ততক্ষণে সন্ধ্যা হয়ে আসে। ডুবুরি দল তল্লাশি করেও তাঁর সন্ধান পায়নি। পরদিন শনিবার দুপুরে ২১ ঘণ্টা পর হাওরের এক পাশে তাঁর ভাসমান লাশ উদ্ধার করা হয়। 

ছেলের শোকে বারবার জ্ঞান হারান মা তাহমিনা নুর। আজ সকাল সাড়ে দশটায় রাউজানের গহিরার মোবারকখিল গ্রামের বাড়িতে
ছবি: প্রথম আলো

আবিদুরদের গহিরার বাড়িতে বসে কথা হয় তাঁর বাবা সারোয়ার জামান খানের সঙ্গে। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, বৃহস্পতিবার রাতে তাঁর মায়ের সঙ্গে শেষ কথা হয় আবিদুরের। এরপর আর কথা হয়নি কারও সঙ্গে। এমনকি হাওরে বেড়াতে যাওয়ার কথাও বলে যাননি। শুক্রবার বিকেলে এক বন্ধুর ফোন পেয়ে তিনি ছেলের মোবাইলে কল দিয়ে দেখেন রিং হচ্ছে তখনো। তিনি বিশ্বাস করতে পারছিলেন না ছেলের এমন বিপদের কথা। পরে জানতে পারেন সবাই বোটে ফোন রেখে হাওরের পানিতে গোসলে নামেন। তিনি বলেন, আশা ছিল ছেলেকে একজন ভালো প্রকৌশলী বানাবেন। কিন্তু হঠাৎ ঝড়ে তাঁর পরিবার পুরো এলোমেলো।

আবিদুরের মামাতো ভাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আহনাফ আজিম চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, ঢাকায় মাঝেমধ্যে তাঁদের দেখা হতো। তখন আড্ডা হতো। হঠাৎ ভাইয়ের দুর্ঘটনার খবরে তিনি ছুটে আসেন রাউজানে। এভাবেই ভাইকে বিদায় দিতে হবে, তা ভাবতে পারছেন না আজিম।

লাশের গাড়িতে করে কিশোরগঞ্জ থেকে রাউজানে আসা আবিদুরের সহপাঠী আশিকুল মোস্তাফা সারাক্ষণই চোখ মুছছিলেন। বললেন, তাঁদের মধ্যে একমাত্র আবিদুরই সাঁতার জানতেন। তাই তাঁর কিছু হবে, এটা ভাবতেই পারেননি কেউ। ছবি তুলতে তুলতে আবিদুর সবার কাছ থেকে ৫ থেকে ৭ ফুট দূরে চলে যান। সেখানে স্রোত ছিল। সাঁতরে স্রোত পেরিয়ে আসার চেষ্টা করেও তিনি পারেননি। তাঁরা আবিদুরকে বাঁচাতে পারেননি। চোখের সামনে তলিয়ে গেলেন তিনি।