দালাল ধরে ইতালি যাওয়ার চেষ্টা করে লিবিয়ায় জিম্মি ২৪ বাংলাদেশি
কিশোরগঞ্জের ভৈরব পৌর শহরের বাসিন্দা ফারুক মিয়াকে সাগরপথে ইতালি পাঠাবেন বলে তাঁর বাবা ইউনুছ মিয়া বছরখানেক আগে রাসেল মিয়া নামের একজনের হাতে ২৪ লাখ টাকা তুলে দেন। মাস ছয়েক আগে ফারুক যাত্রা করেন। কিন্তু তাঁর স্বপ্নযাত্রা সফল হয়নি। এখন তিনি লিবিয়ায় আছেন জিম্মি অবস্থায়।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, একই সময়ে দালাল রাসেল চক্রের মাধ্যমে ভাগ্যান্বেষণে সাগরপথে ইতালি পাড়ি জমাতে ভৈরব, কিশোরগঞ্জ, হবিগঞ্জ ও নরসিংদী এলাকার অন্তত ২৪ জন লিবিয়া যান। তাঁদের কেউ এখন পর্যন্ত ইতালি পৌঁছাতে পারেননি। তাঁদের কেউ এখন অপহরণকারীর হাতে জিম্মি, আবার কেউ আছেন লিবিয়ার কারাগারে। অপহরণকারীরা প্রতিনিয়ত তাঁদের ওপর শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন চালিয়ে মুক্তিপণ হিসেবে মোটা অঙ্কের টাকা দাবি করছেন। জিম্মিদের ওপর চালানো নির্যাতনের কথা জেনে দেশে থাকা স্বজনেরা শঙ্কা আর অনিশ্চয়তায় মধ্যে দিন পার করছেন।
৫ জুলাই দালাল রাসেল ভুক্তভোগী পরিবারের সদস্যদের রোষানলে পড়ে উত্তমমধ্যমের শিকার হন। পরে পুলিশ তাঁকে ধরে নিয়ে মানব পাচার আইনে কিশোরগঞ্জ জেলা কারাগারে পাঠায়।
স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ভৈরবে ১০ বছর আগে সাগরপথে লিবিয়া হয়ে অবৈধ প্রক্রিয়ায় ইতালি পাঠানোর একাধিক দালাল চক্র মাঠপর্যায়ে সক্রিয় হয়। চক্রগুলোর মাধ্যমে অনেকে ইতালি যেতে পারেন। বর্তমানে সবচেয়ে সক্রিয় আছে রাসেল চক্র। তারা ভৈরব ছাড়াও কয়েকটি জেলা থেকে লোকজনকে ইতালির উদ্দেশে পাঠায়। সর্বশেষ তারা ইতালি পাঠানোর কথা বলে ভৈরব, কিশোরগঞ্জ, হবিগঞ্জ ও নরসিংদী এলাকার ২৪ জনের কাছ থেকে কয়েক কোটি টাকা নেয়। তবে কেউই ইতালি যেতে পারেননি। জিম্মি অবস্থা থেকে ভুক্তভোগীরা পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করে নিজেদের কষ্টের কথা জানান। টাকা দিয়ে তাঁদের মুক্ত করার আকুতি জানিয়ে আসছেন। এমন বিপদের সময় রাসেল ও চক্রের সদস্যরা নিজেদের আড়াল করে রাখেন। ভুক্তভোগী পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেন। এতে ভুক্তভোগী পরিবারের সদস্যদের রাসেল ও তাঁর সহযোগীদের ওপর ক্ষোভ বাড়তে থাকে। প্রতিকার পেতে ভুক্তভোগী পরিবারের সদস্যরা সমাজপতিদের দ্বারস্থ হন। কিন্তু ফল পাননি।
৫ জুলাই রাসেল নিজের বাড়ি পৌর শহরের জগন্নাথপুর আসেন। এই তথ্য জানতে পেরে ভুক্তভোগী পরিবারগুলো তাঁকে ঘেরাও করে মারধর করে পুলিশে দেয়।
ভুক্তভোগী নরসিংদীর শিবপুর এলাকার শফিকুল ইসলামের বাবা এবাদুল্লাহ বলেন, ‘ইতালি পাঠানোর কথা বলে রাসেল ২৩ লাখ টাকা নিয়েছে। এখন ছেলেকে মুক্ত করতে চাচ্ছে ১০ লাখ টাকা। চেষ্টা করেও এত টাকা জোগাড় করতে পারছি না।’
ভৈরব পৌর শহরের বাসিন্দা হাসেন আলীর বাবা রইছ উদ্দিন বলেন, তিন মাস ধরে ছেলের অবস্থান সম্পর্কে কোনো কিছু জানতে পারছেন না। কেবল এতটুকু জানতে পেরেছেন, ছেলে এখন জিম্মি। প্রতিদিন খাওয়া দেয় না। মারধর করে আর মোটা অঙ্কের টাকা চায়।
কিশোরগঞ্জের তোফায়েল আহমেদ ও নরসিংদীর শিবপুর এলাকার সবুজ মিয়ার কাছ থেকে রাসেল নিয়েছেন ২২ লাখ টাকা করে। তাঁদের পরিবারের সদস্যরা বলেন, প্রতিনিয়ত নির্যাতন করার কথা কানে আসছে। মুক্তিপণ হিসেবে মোটা অঙ্কের টাকা চাওয়া হচ্ছে। কিন্তু টাকা দিলে মুক্তি পাবে, এমন নিশ্চয়তার কাউকে পাওয়া যাচ্ছে না। ফলে অনিশ্চয়তা আর শঙ্কার মধ্যে দিন পার করতে হচ্ছে তাঁদের।
ইতালি পাঠানোর প্রতিশ্রুতিতে টাকা নেওয়ার কথা পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে স্বীকার করেছেন রাসেল মিয়া। তিনি বলেন, ইতালি পাঠানোর সব উদ্যোগ নিলেও সাগরপথে নতুন করে সমস্যা দেখা দেওয়ায় সবাইকে পাঠাতে পারছিলেন না। এতে সবাই অধৈর্য হয়ে যায়। এই কারণে তাঁর পক্ষে পরিস্থিতি সামাল দেওয়া সম্ভব হয়নি।
ভৈরব থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. সফিকুল ইসলাম বলেন, অবৈধ প্রক্রিয়ায় ইতালি পাঠানোর কথা বলে রাসেলের বিরুদ্ধে ২৪ জনের কাছ থেকে কয়েক কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ আছে। এর মধ্যে রাসেল আটক হওয়ার পর ভুক্তভোগীদের পক্ষ থেকে শফিকুলের বাবা এবাদুল্লাহ বাদী হয়ে মামলা করেন। রাসেলকে ওই মামলায় কারাগারে পাঠানো হয়। ভুক্তভোগীদের অভিযোগ তদন্ত করে দেখা হচ্ছে।