গত বৃহস্পতিবার মধ্যাহ্নে আমরা যখন খাগড়াছড়ির দীঘিনালায় পৌঁছাই, তখন পাহাড়ি জনপদটি ছিল মেঘবন্দী। আশপাশে জনমানুষ নেই। বর্ষণের ধ্বনি ছাড়া অন্য কোনো শব্দ নেই। ভারী বর্ষণের ভেতর খাগড়াছড়ি থেকে ২০ কিলোমিটার পথ পাড়ি দেওয়ার সময় মেঘগুলো মাথার কাছে নেমে এসে বৃষ্টি ঢেলে দিচ্ছিল। গাঢ় সবুজ সারি সারি পাহাড়গুলো যেন পানির তোড়ে অতিকায় জাহাজের মতো ভেসে যাবে!
দীঘিনালার বোয়ালখালী বাজার থেকে দুই কিলোমিটার পাহাড়ের চূড়ায় বোয়ালখালী সর্বজনীন শালবন বৌদ্ধবিহারের দিকে যেতে যেতে মাইকের আওয়াজ পেলাম। বিহারে পৌঁছেই দেখলাম এর সামনের কাদামাখা চত্বরে শত শত মানুষ। ওপরে ত্রিপল আর শামিয়ানা দেওয়া হয়েছে। কিন্তু ভারী বৃষ্টির কারণে ত্রিপলের নিচেও পানি আসছে। পাহাড়ের নানা জায়গা থেকে মানুষ এসে ভিড় করেছেন।
দীর্ঘ এই চত্বরের এক পাশে মঞ্চ সাজানো হয়েছে। সেখানে বৌদ্ধ ভিক্ষুরা বসবেন। মঞ্চের পাশে ফুলে ফুলে সাজানো শকটে, ফুলের বিছানায় নীরবে শুয়ে আছেন প্রথম আলোর দীঘিনালা প্রতিনিধি সদ্য প্রয়াত পলাশ বড়ুয়া। তাঁর পায়ের কাছে সদ্য বিধবা স্ত্রী ঊর্মি বড়ুয়া এবং দুই ছেলে নিলয় বড়ুয়া ও পার্থ বড়ুয়া। চারপাশে অপেক্ষমাণ মানুষ। এরই মধ্যে ভিড় ঠেলে পলাশের শেষ শয্যার কাছে এসে মানুষ ফুল দিয়ে যাচ্ছেন। কেউ কেউ প্রণাম করছেন। তাঁরা পলাশের আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব, খাগড়াছড়ির সাধারণ মানুষ। কেউ কেউ জনপ্রতিনিধি, কেউ কেউ সরকারি-বেসরকারি সংস্থার কর্মকর্তা।
মঞ্চের পেছনে বিশাল ব্যানারে লেখা অনিত্য সভা, পলাশ বড়ুয়া। এই অনিত্য সভায় সবাই পলাশের কথা বলতে বলতে অশ্রুসজল হয়ে পড়ছেন। পলাশের জীবনের নানা দিক তুলে ধরলেন তাঁরা। পলাশকে জানতাম একজন সুসাংবাদিক হিসেবে, কাজের প্রতি আন্তরিকতা ও একনিষ্ঠতার কথা আমরা জানতাম। অনিত্য সভায় আগত শত শত অশ্রুসজল মানুষ ঘণ্টার পর ঘণ্টা তাঁর সম্পর্কে কথা শুনেছেন। বক্তারা বলেছেন, পলাশ কখনো নিজের স্বার্থে কিছু করেননি। এমন পরার্থপর মানুষ, সৎ ও নিষ্ঠাবান সাংবাদিক দীঘিনালায় দ্বিতীয়টি নেই।
চারদিকে প্রবল বাতাস আর তুমুল বৃষ্টি। এমন প্রতিকূল আবহাওয়াকে উপেক্ষা করে পাহাড়ের পথ বেয়ে মানুষ শালবন বিহারের দিকে ছুটে এসেছেন তাঁদের প্রিয় মানুষটিকে শেষবার দেখার জন্য। ফুলের ওপর পলাশ শুয়ে আছেন। আর কোনো দিন দীঘিনালার মানুষের দুঃখ-দুর্দশা, পাহাড়ের অপরূপ কথা, প্রকৃতির সৌন্দর্যের কথা তিনি লিখবেন না।
২ আগস্ট সন্ধ্যায় ঢাকার একটি বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় পলাশ বড়ুয়া মারা যান।
গত ফেব্রুয়ারি মাসে সাজেক যাওয়ার পথে দীঘিনালার বোয়ালখালী বাজারে তাঁর সঙ্গে শেষ দেখা হয়েছিল। আমাকে জড়িয়ে ধরে বুকের সঙ্গে বুক লাগিয়ে অনেকক্ষণ চুপ করে ছিলেন তিনি। বলেছিলেন, এই শুকনা মৌসুমে পাহাড়ে এসে কী করবেন? বর্ষায় আসেন। দেখবেন পাহাড় কী সুন্দর! যেন একটা অতি গোপন কথা বলবেন, এমন ভঙ্গি করে আমার কানের কাছে ফিসফিস করে বলেছিলেন, ‘আমাদের দীঘিনালা হচ্ছে ঝরনার গ্রাম। তৈদুছড়া, তোজেংমা, হাজাছড়া, হরিণমারা আরও কত ঝরনা বর্ষায় আপনার পায়ের কাছে এসে খিলখিল করে হাসবে।’
তাঁর কথা আমাকে মানতে হলো। আমাকে আসতে হলো। শ্রাবণ তাঁর প্রকৃত রূপ নিয়ে পাহাড়ের প্রকৃতিতে ফিরে এসেছে। কিন্তু পাহাড়ের বৃষ্টির এই মুখরতাকে কান্নার মতো মনে হচ্ছিল। এসে দেখলাম এখানে শ্রাবণ আজ ‘পলাশরাঙা’ হয়ে আছে। তৈদুছড়ার জল আত্মহারা হয়ে প্রবল স্রোত নিয়ে কোথায় হারিয়ে যাচ্ছে। তার রূপ আমাকে যিনি দেখাবেন বলেছিলেন, তিনিও তো হারিয়ে গেছেন। ওই দূরে মেঘের ওপারে...