পলিমাটি জমায় এক বছর আগে খনন করা হয়েছিল কক্সবাজারের মহেশখালী জেটিঘাটে। বছর না যেতে আবারও তা ভরাট হয়ে গেছে। এতে ভাটার সময় স্পিডবোট ও যাত্রীবাহী নৌকা থেকে নেমে কাদা মাড়িয়ে জেটিতে উঠতে হচ্ছে যাত্রীদের। মহেশখালী থেকে নৌপথে কক্সবাজারে যাতায়াতের ক্ষেত্রে যাত্রীদের একই ধরনের ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে অপর প্রান্তেও। খাল ভরাট হয়ে যাওয়ায় ভাটার সময় নদী থেকে কাঠের নৌকা কিংবা স্পিডবোট সরাসরি কক্সবাজারের ৬ নম্বর জেটিঘাটে ভিড়তে পারছে না। বিকল্প হিসেবে শহরের নুনিয়ারছড়া জেটিঘাট দিয়ে যাত্রীদের আসা-যাওয়া করতে হচ্ছে। অথচ এই দুটি জেটিঘাট এলাকায় গত বছর খননে (ড্রেজিং) ব্যয় হয়েছে প্রায় দেড় কোটি টাকা।
গত বর্ষা মৌসুমে বন্যার কারণে আবারও দুটি জেটিঘাট এলাকায় পলিমাটি জমেছে বলে দাবি বিআইডব্লিউটিএ কর্মকর্তাদের। তাঁরা বলছেন, যাত্রীদের ভোগান্তি দূর করতে এ দুটি ঘাটের পাশাপাশি খনন করতে হবে মহেশখালীর আদিনাথ মন্দিরসংলগ্ন জেটিঘাটেও। এতে খরচ হবে প্রায় তিন কোটি টাকা। সম্প্রতি নিয়মিত খননকাজ শুরু হয়েছে বলেও জানান বিআইডব্লিউটিএর কর্মকর্তারা।
বিবিএসের সর্বশেষ শুমারি অনুযায়ী মহেশখালীতে জনসংখ্যা রয়েছে ৩ লাখ ৮৫ হাজারের বেশি। দ্বীপ উপজেলাটির বাসিন্দারা জেলা সদরে যাতায়াত করেন মূলত নৌপথেই। এর বাইরে আদিনাথ মন্দিরসহ ঐতিহ্যবাহী নানা স্থাপনা দেখতে মহেশখালীতে প্রতিদিনই হাজারো পর্যটক যাতায়াত করেন। জেটিঘাট ভরাট হওয়ায় এসব পর্যটক ও স্থানীয় বাসিন্দাদের ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে।
স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, মহেশখালী উপজেলার গোরকঘাটার পূর্ব পাশে ১৯৮৮ সালে প্রায় ১ কোটি ২০ লাখ টাকা ব্যয়ে ৫০০ মিটার দৈর্ঘ্য এবং ৩ দশমিক ৩ মিটার প্রস্থের একটি জেটি নির্মাণ করা হয়। নদী ভরাট হয়ে যাওয়ার কারণে ২০০০ সালে প্রায় এক কোটি টাকা ব্যয়ে জেটির পূর্ব পাশে আরও ১০০ মিটার সম্প্রসারণ করা হয়েছে। তবু জেটির দুপাশে দিন দিন ভরাট হয়ে যাওয়ায় ভাটার সময় নৌযানে ওঠানামা করতে গিয়ে যাত্রীদের চরম ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছিল। এ ছাড়া বিভিন্ন দুর্ঘটনার শিকার হচ্ছিলেন তাঁরা। যাত্রীদের ওঠানামার সুবিধার্থে এক বছর আগে জেটিঘাটটি ড্রেজার দিয়ে খনন করা হয়। তবে কয়েক মাস না যেতেই জেটিঘাট–সংলগ্ন এলাকা আবারও ভরাট হতে শুরু করে। এতে পাঁচ মাস ধরে যাত্রীদের আবারও ভাটার সময় ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে।
সম্প্রতি সরেজমিন গিয়ে দেখা গেছে, খাল ভরাট হয়ে যাওয়ায় ভাটার সময় মহেশখালী নৌপথে চলাচলকারী নৌযানগুলো কক্সবাজারের ৬ নম্বর জেটিঘাটে ভিড়তে পারছে না। এ কারণে ভাটার সময় নুনিয়ারছড়া জেটিঘাট দিয়ে এসব নৌযান যাতায়াত করছে। ভাটার সময় মহেশখালী জেটিঘাটে গিয়েও যাত্রীদের দুর্ভোগের চিত্র দেখা যায়। কাঠের নৌকা ও স্পিডবোট থেকে নেমে ডিঙিনৌকায় করে যাত্রীদের জেটিঘাটে উঠতে হচ্ছিল। এদিকে আদিনাথ জেটিঘাটে গিয়ে দেখা যায়, জেটিঘাট থেকে নেমে অনেকটাই কাদামাটির সঙ্গে লেপ্টে থাকা ভাঙা সাঁকোর ওপর দিয়ে যাত্রীরা নৌযানে ওঠানামা করছেন। এতে পর্যটকদের ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছিল।
আদিনাথ জেটিতে কথা হয় সিলেট থেকে ঘুরতে আসা পর্যটক কামাল উদ্দিনের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘পাহাড়-সাগর একসঙ্গে দেখার অপরূপ স্থান মহেশখালী। আদিনাথ মন্দির, মৈনাক পাহাড়ের কথা জেনে এই উপজেলা ভ্রমণে এসেছি। সাগর পাড়ি দিয়ে মহেশখালীতে আসার পর জেটিঘাটে খুব ভোগান্তিতে পড়তে হয়েছে। এত কষ্ট জানলে পরিবার-পরিজন নিয়ে আসতাম না।’ তিনি বলেন, ‘স্পিডবোট যখন থেমেছে তখন কোনো ঘাট চোখে পড়ছিল না। অনেকক্ষণ পর খেয়াল করি, আনুমানিক ৩০০ মিটার দূরে একটি জেটি। পরে সাঁকো বেয়ে সেই জেটিতে উঠলাম।’
গাজীপুর থেকে আসা আরেক পর্যটক মিনহাজুল আবেদীন বলেন, এই এলাকার মানুষ এত কষ্ট করে যাতায়াত করে, তা আগে জানা ছিল না। বলতে গেলে তাঁরা প্রতিদিন দুর্ঘটনার ঝুঁকি নিয়ে পারাপার করছেন। তিনি আরও বলেন, পর্যটকেরা কক্সবাজার বেড়াতে এলেই মহেশখালী ঘুরে যাওয়ার পরিকল্পনা করেন। পর্যটনের কথা মাথায় রাখলেও জেটিঘাটের সমস্যার স্থায়ী সমাধান করার কথা।
কথা হয় মহেশখালীর কুতুবজোম ইউনিয়নের তাজিয়াকাটার বাসিন্দা আশেক ইলাহি ও নুর মোহাম্মদের সঙ্গে। তাঁরা বলেন, জেটি থেকে প্রতিবছর সরকার কয়েক লাখ টাকা রাজস্ব আদায় করছে; কিন্তু যাত্রীদের পাশাপাশি পর্যটকদের সুবিধার্থে জেটি সম্প্রসারণ বা খাল খনন করার ব্যাপারে যথাযথ ভূমিকা দেখা যায় না। একটি স্পিডবোটের চালক মোস্তফা কামাল বলেন, ছয় মাস আগেও ভাটার সময় জেটি থেকে সরাসরি যাত্রীদের ওঠানামা করা সম্ভব হতো। এখন নৌযান জেটিতে ভেড়ানো সম্ভব হচ্ছে না। বিকল্প হিসেবে কাঠের জেটি নির্মাণ করে তা দিয়ে যাত্রীরা ওঠানামা করছেন। আদিনাথ ঘাটের অবস্থা আরও করুণ।
মহেশখালী স্পিডবোট মালিক সমিতির সভাপতি আতা উল্লাহ বোখারী বলেন, শীত মৌসুম ঘিরে এখন মহেশখালীতে দেশি-বিদেশি পর্যটক বেড়েছে। দিনে অন্তত পাঁচ হাজার মানুষ জেটিঘাট দিয়ে যাতায়াত করছেন। এর মধ্যে পর্যটক থাকেন পাঁচ শতাধিক। জেটিঘাট এলাকা ভরাট হয়ে যাওয়ায় যাত্রীরা ভোগান্তিতে পড়ছেন।
মহেশখালী-কক্সবাজার নৌপথে যাত্রীদের ভোগান্তির বিষয়ে দীর্ঘদিন ধরে বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করে আসছেন স্থানীয় কিছু বাসিন্দা। তাঁদেরই একজন এস এম রুবেল বলেন, ‘জেটিঘাট ভরাট হয়ে যাওয়ায় মানুষের দুর্ভোগের শেষ নেই। দ্রুত খননকাজ সম্পন্ন করার বিষয়ে বিআইডব্লিউ কর্তৃপক্ষকে আমরা দাবি জানিয়ে আসছি। তবে খননকাজ চলে খুবই ধীরগতিতে।’
জানতে চাইলে বিআইডব্লিউটিএর কক্সবাজারের নির্বাহী প্রকৌশলী রেজা খন্দকার প্রথম আলোকে বলেন, প্রায় দেড় কোটি টাকা ব্যয়ে গত বছর মহেশখালী জেটিসংলগ্ন ৮০০ মিটার এবং কক্সবাজার ৬ নম্বর ঘাটসংলগ্ন বাঁকখালী চ্যানেলের ১ দশমিক ২৫ কিলোমিটার খনন করা হয়েছিল। তবে এরপর বন্যার কারণে আবারও পলিমাটি জমে গেছে। এ বছর অন্তত চার কিলোমিটার এলাকা ড্রেজিং করতে হবে, যাতে তিন কোটি টাকা খরচ হবে। তিনি বলেন, নিজস্ব ড্রেজারে খনন কার্যক্রম শুরু হয়েছে। তাই দরপত্র আহ্বান করার প্রয়োজন হয়নি।
যাত্রীদের সুবিধার্থে নতুন জেটি
স্থানীয় বাসিন্দাদের পাশাপাশি পর্যটকদের যাতায়াতের সুবিধার্থে ২০২৩ সালের শুরুতে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে স্থানীয় প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি) মহেশখালীতে নতুন করে আরও একটি জেটি নির্মাণের উদ্যোগ নেয়। পরে ওই নতুন জেটি নির্মাণের জন্য স্থানীয় প্রকৌশল অধিদপ্তর দরপত্র আহ্বান করে। প্রায় ৩৬ কোটি ৪৮ লাখ টাকা ব্যয়ে ওই জেটি নির্মাণের দায়িত্ব পান ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান আবছার কনস্ট্রাকশন। এই জেটির দৈর্ঘ্য ৭০০ মিটার ও প্রস্থ ৭ দশমিক ৩ মিটার। ৭০০ মিটারের জেটির মধ্যে ৩০০ মিটার সংযোগ সড়ক নির্মাণ করা হবে। এর নির্মাণকাজ ২০২৩ সালের এপ্রিলে শুরু হয়েছে। চলতি বছরের জুনে কাজ শেষ হওয়ার কথা।
জানতে চাইলে এলজিইডির উপজেলা প্রকৌশলী মোহাম্মদ বনি আমিন বলেন, নতুন জেটির নির্মাণকাজ শেষ হলে এই দ্বীপের বাসিন্দাদের নৌপথে যাতায়াতের ভোগান্তি আর থাকবে না। ইতিমধ্যে নতুন জেটির কাজ ৫০ শতাংশ শেষ হয়েছে। বাকি কাজও যথাসময়ে শেষ হবে।
মহেশখালী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. হেদায়েত উল্যাহ প্রথম আলোকে বলেন, যাত্রীদের ভোগান্তি দূর করতে ভরাট হওয়া জেটিঘাটে খননকাজ দ্রুত শেষ করতে বিআইডব্লিউটিএকে বলা হয়েছে। নতুন জেটি নির্মাণের কাজও চলছে।