ভূমিহীন কৃষকের সন্তান ছিলেন ইমাম হোসেন। ইচ্ছা ছিল পড়াশোনা করার, কিন্তু দারিদ্র্যের কারণে পঞ্চম শ্রেণির পর বিদ্যালয়ে যাওয়া হয়নি। প্রতিজ্ঞা করেছিলেন, সন্তানদের ক্ষেত্রে এমনটা হতে দেবেন না। পেশায় অটোরিকশাচালক ইমাম হোসেন নানা প্রতিকূলতার মধ্যে দুই সন্তানকে উচ্চশিক্ষিত করেছেন। এখন তাঁকে একজন সফল বাবার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হিসেবেই দেখেন এলাকার মানুষ।
ইমাম হোসেনের বাড়ি পিরোজপুরের কাউখালী উপজেলার কেউন্দিয়া গ্রামে। তাঁর ছেলে মেহেদী হাসান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ট্যুরিজম অ্যান্ড হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট বিষয়ে স্নাতকোত্তর করেছেন। মেয়ে ফাতেমা আক্তার সরকারি ব্রজমোহন কলেজ থেকে গণিতে এমএসসি পাস করেছেন। ইমাম হোসেন তরুণ বয়সে ভ্যান চালিয়ে সংসারের হাল ধরেছিলেন। এরপর কখনো রিকশা চালিয়েছেন। আবার জমিও চাষ করেছেন। বর্তমানে তিনি ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা চালান।
ইমাম হোসেন জানান, তাঁর বাবা আক্কেল আলী ভূমিহীন কৃষক ছিলেন। উপজেলার কেউন্দিয়া গ্রামে অন্যের জমিতে পাঁচ সন্তান নিয়ে বসবাস করতেন। শৈশব থেকে দারিদ্র্যের মধ্য দিয়ে বড় হয়েছেন। পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করার পর বাবার সঙ্গে কৃষিশ্রমিকের কাজ শুরু করেন। বিয়ের পর ভ্যান ও পরে রিকশা চালানো শুরু করেন।
আমার বাবা সংগ্রামী মানুষ। আমাদের দুই ভাই–বোনকে মানুষ করেছেন। তিনি কষ্ট করলেও আমাদের বুঝতে দেননি।
ইমাম হোসেন দুই সন্তানের পড়াশোনার ব্যাপারে ছিলেন সচেতন। ছেলে ও মেয়েকে বিদ্যালয়ে ভর্তি করার পর বাড়িতে গৃহশিক্ষক রেখেছিলেন। সারা দিন রিকশা চালিয়ে রাতে সন্তানদের পাশে বসে পড়াশোনার খোঁজখবর নিতেন। পড়াশোনার জন্য আলাদা করে টাকা জমিয়ে রাখতেন। বাড়তি আয়ের জন্য রিকশা চালানোর পাশাপাশি অন্যের জমি বর্গা নিয়ে চাষ ও গরু পালন করেছেন। ছেলে মেহেদী হাসান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পর প্রতি মাসে ছয় থেকে সাত হাজার টাকা পাঠিয়ে দিতেন।
ইমাম হোসেন বলেন, ‘আমি অভাবের কারণে পড়াশোনা করতে পারিনি। কিন্তু সন্তানদের পড়াশোনা করানোর স্বপ্ন দেখেছিলাম। সন্তানদের পড়াশোনার পাশাপাশি ৯ কাঠা জমি কিনে বাড়ি করেছি, যাতে আমার সন্তানদের নিজেদের বাড়ি নেই ভেবে মন ছোট না হয়। নিজে রিকশা-ভ্যান চালিয়েছি। এখনো ইজিবাইক চালাচ্ছি। নিজে কষ্ট করলেও সন্তানদের কখনো কষ্ট বুঝতে দিইনি। পড়ালেখার জন্য যখন যা প্রয়োজন কষ্ট করে হলেও পূরণ করেছি।’ ছেলে-মেয়ে দুজন মাস্টার্স পাস করেছেন। এলাকার মানুষ সন্তানদের জন্য এখন তাঁকে সম্মান করেন। বাবা হিসেবে এটা তাঁর আত্মতৃপ্তি বলে মনে করেন ইমাম হোসেন।
মেহেদী হাসান ২০১৫–১৬ শিক্ষাবর্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। স্নাতকোত্তর শেষে বর্তমানে চাকরির প্রস্তুতি নিচ্ছেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের পড়াশোনার ব্যাপারে বাবার সহযোগিতা ছিল বলেই আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়াশোনা শেষ করতে পেরেছি। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনার সময়ে বাবা প্রতি মাসে টাকা পাঠাতেন। আমি প্রাইভেট পড়িয়ে চলছি। এখনো বাবা মাঝেমধ্যে টাকা পাঠান। তিনি এখনো আমাদের জন্য কষ্ট করে যাচ্ছেন। আমার চাকরি হলে বাবাকে আর ইজিবাইক চালাতে দেব না।’
মেয়ে ফাতেমা আক্তার বলেন, ‘আমার বাবা সংগ্রামী মানুষ। পরিশ্রম করে জমি–বাড়ি করেছেন। আমাদের দুই ভাই–বোনকে মানুষ করেছেন। তিনি কষ্ট করলেও আমাদের বুঝতে দেননি।’
ইমাম হোসেনের প্রতিবেশী কাউখালী উন্নয়ন পরিষদের সভাপতি আবদুল লতিফ বলেন, ইমাম হোসেন সন্তানদের পড়াশোনার ব্যাপারে সব সময়ে সচেতন ছিলেন। তিনি সন্তানদের পড়াশোনার ব্যাপারে পরামর্শ করতে আসতেন। অল্প শিক্ষিত হলেও পড়াশোনা ব্যাপারে খুব আগ্রহী ছিলেন বলে তাঁর সন্তানেরা উচ্চশিক্ষিত হয়েছেন। একজন সফল বাবার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত ইমাম হোসেন।