মৌলভীবাজারের যে গ্রামের মাঠজুড়ে ঝিঙেখেত
গ্রামটির যেদিকে চোখ যায়, সেদিকেই ছড়িয়ে আছে ঝিঙেখেত। রাস্তার দুই পাশে, বাড়ি ও টিলার ফাঁকে ফাঁকে ধূসর-সবুজ রঙের খেত ছড়ানো। বাঁশের কঞ্চি, গাছের শুকনো ডালপালায় জড়িয়ে আছে ঝিঙের ঝাড়। গাছে গাছে ঝুলে আছে বিভিন্ন আকারের ঝিঙে, ঝিঙে ফুল।
মৌলভীবাজারের বড়লেখা উপজেলার মোহাম্মদনগর ঝিঙের গ্রাম হয়ে উঠেছে। অনেক বছর ধরেই বাণিজ্যিকভাবে ঝিঙের চাষ হচ্ছে গ্রামে। ঝিঙে চাষ গ্রামবাসীর আত্মকর্মসংস্থানসহ অনেকের বাড়তি আয়ের উপায় হয়ে উঠেছে। মোহাম্মদনগরে প্রায় ২০০ বিঘা জমিতে ঝিঙের চাষ হচ্ছে।
এক বিকেলে মোহাম্মদনগরে গিয়ে দেখা গেছে, সড়কের দুই পাশে ঝিঙের খেত। লাগাতার একের পর এক জমিতে ঝিঙে চাষ করা হয়েছে। গ্রামের ভেতরে, টিলার দিকেও এই ঝিঙের চাষ হয়েছে। এই সব খেতের মধ্যে একটিমাত্র খেতে বাঁশের মাচা দেখা গেছে। বাকি সব খেতেই মাচার বদলে বাঁশের আগা (কঞ্চি), গাছের মরা ডাল পুঁতে দেওয়া হয়েছে। এসব ডাল ও কঞ্চি আঁকড়ে আছে ঝিঙের ঝাড়। এসব ঝাড়ে ঝুলছে ছোট-বড় ঝিঙে। তবে খেতে পরিপক্ব ঝিঙের পরিমাণ কম ছিল। আগের দিন ঝিঙে বিক্রি করা হয়েছে বলে এমন অবস্থা, জানালেন কৃষকেরা।
মোহাম্মদনগরের কৃষক আবদুর রহিম (৬৫) বলেন, ‘ঝিঙে চাষে লাভ বেশি। এর লাগি বুড়া বেটা অই গেছি লালচ ছাড়তাম পারি না (বৃদ্ধ হয়ে গেছি, তা–ও এর লোভ ছাড়তে পারছি না)।’ তিনি জানিয়েছেন, দেড় কিয়ার (১ কিয়ার সমান ৩০ শতাংশ) জমিতে ঝিঙের চাষ করেছেন। বীজ, জমি তৈরি, কঞ্চি-ডালপালা কেনাসহ বিভিন্নভাবে প্রায় ২৫ হাজার টাকা খরচ হয়েছে। এ পর্যন্ত ৪০ হাজার টাকার ঝিঙে বিক্রি করেছেন। আরও ৪০ হাজার টাকার ঝিঙে বিক্রির আশা তাঁর। গত বছর প্রায় এক লাখ টাকার ঝিঙে বিক্রি করেছিলেন। তবে আরও দেড় কিয়ার জমিতে টমেটো, বেগুন, ঢ্যাঁড়স, বরবটি ও আলু চাষ করেছেন তিনি।
মো. ফখরুদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, ‘আগে শুধু হালি চারার জমিতে ঝিঙে চাষ করতাম। এখন সাইল (আমন ধান চাষের জমি) জমিতেও ঝিঙে চাষ করি। এই গ্রামের বেশির ভাগ মানুষ কৃষিনির্ভর। অন্য কোনো কাজ নাই। ঝিঙে চাষ করে কম-বেশি সবাই লাভবান। ঝিঙে চাষে তেমন কোনো সমস্যা নাই। শুধু শুকনা মৌসুমে পানির সংকট আছে।’
কৃষি বিভাগ ও চাষিদের সূত্রে জানা গেছে, মোহাম্মদনগরে বহু বছর ধরেই ঝিঙে চাষ হচ্ছে। মানুষ কম ছিল, চাষও কম হতো। দুই-চার কেজি ফসল হাতে-ব্যাগে করে নিয়ে বাজারে নিয়ে বিক্রি করতেন কেউ কেউ। নব্বই দশকের শেষ দিক থেকে বাণিজ্যিকভাবে ঝিঙে চাষের প্রসার ঘটে এখানে। এখন প্রায় ৭৫ ভাগ পরিবারই ঝিঙে চাষের সঙ্গে যুক্ত।
আলু তোলার পরপরই ফেব্রুয়ারি মাসের শেষের দিকে শুরু হয় ঝিঙে চাষ। রোপণের ৫০ থেকে ৫৫ দিন পর শুরু হয় ফসল তোলা। সেটা চলে তিন থেকে সাড়ে তিন মাস। আগাম তোলা ফসল ৪৫ থেকে ৫৫ টাকা প্রতি কেজি বিক্রি হয়েছে। এখন ৪০ থেকে ৪৫ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। সপ্তাহের রবি, মঙ্গল ও শুক্রবার—এই তিন দিন বড়লেখা সদরে হাটবার। ওই দিনগুলোতে সকালবেলা চাষিরা বড়লেখাতে ঝিঙে নিয়ে যান। সেখানে বিভিন্ন স্থান থেকে আসা পাইকারদের কাছে ঝিঙে বিক্রি করেন। কোনো কোনো পাইকার খেত থেকেও ফসল নিয়ে যান। তিন দিন পরপর খেত থেকে ফসল তোলা হয়। এক কিয়ারে প্রায় ৫০ মণ ঝিঙে ফলে। প্রতি বিঘা জমিতে ২০ থেকে ২৫ হাজার টাকা খরচ এবং ৭০ থেকে ৭৫ হাজার টাকা লাভ হয়। অন্যান্য ফসলের তুলনায় ঝিঙেতে রোগবালাইয়ের আক্রমণ কম এবং লাভজনক হওয়ায় ঝিঙে চাষে কৃষকদের আগ্রহ বেশি।
মোহাম্মদনগরেই ২০ থেকে ৪৫ শতাংশ জমিতে ঝিঙে চাষ করেন এমন কৃষকের সংখ্যা প্রায় ২০০। গ্রামে প্রায় ২০০ বিঘা জমিতে ঝিঙের চাষ হচ্ছে। আর দক্ষিণ শাহবাজপুর ইউনিয়নে চাষ হচ্ছে প্রায় ৪০০ বিঘায়। বড়লেখা উপজেলাতে হচ্ছে ১ হাজার ৩২০ বিঘা জমিতে।
বড়লেখা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. মনোয়ার হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘২০-২৫ বছর ধরে মোহাম্মদনগরে ঝিঙের বাণিজ্যিক চাষ হচ্ছে। কৃষকেরা সারা বছর অপেক্ষা করেন কখন ঝিঙে চাষ করবেন। আমরা স্থানীয়ভাবে কৃষকদের প্রশিক্ষণ দিচ্ছি। সেচের সরঞ্জামাদি, প্রদর্শনী মাঠের কৃষকদের বিনা মূল্যে সার ও বীজ দিয়ে থাকি। ঝিঙে চাষ তাদের জন্য লাভজনক।’