অন্ধত্ব জয় করে এইচএসসিতে জিপিএ-৫, ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কা

দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী হরিবোল বোনার্জিছবি: প্রথম আলো

চা–বাগানের শ্রমিক কলোনিতে জন্ম ও বেড়ে ওঠা। জন্ম থেকেই দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী। অদম্য মনোবল ও চা–শ্রমিক মা-বাবার উৎসাহে কখনো আটকে রাখা যায়নি তাঁকে। দুই চোখে আলো না থাকলেও পড়াশোনার প্রতি গভীর আগ্রহে দুই বছর আগে এসএসসিতে জিপিএ-৫ পাওয়ার পর এবারের এইচএসসি পরীক্ষায়ও জিপিএ-৫ পেয়েছেন তিনি।

দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী এই অদম্য মেধাবীর নাম হরিবোল বোনার্জি। এইচএসসিতে জিপিএ-৫ পেলেও হরিবোলের ভবিষ্যৎ লেখাপড়া নিয়ে উদ্বেগে তাঁর পরিবার। দরিদ্র পরিবার হওয়ায় পড়াশোনার খরচ নিয়ে চিন্তিত। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির ব্যাপারে বিত্তবানদের সহযোগিতা চেয়েছে তাঁর পরিবার।

হরিবোলের বাড়ি মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গল উপজেলার সাতগাঁও ইউনিয়নের হুগলিছড়া চা–বাগানে। বাবা অনিল বোনার্জি ও মা বিশখা বোনার্জি দুজনেই চা–শ্রমিক। তাঁর এক বোন আছে। সে-ও পড়ছে।

হরিবোল বলেন, তাঁর জন্মের পর থেকেই মা-বাবা অনেক উপহাসের সম্মুখীন হয়েছেন। কখনো পড়াশোনা করতে পারবেন ভাবতে পারেননি। প্রথমে ব্র্যাক স্কুলে ভর্তি হলেও দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীদের ব্রেইল পদ্ধতি না থাকায় প্রথম তিন বছর পড়তে পারেননি। ২০১২ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে পড়ালেখায় হাতেখড়ি। ২০১৬ সালে পিএসসি পরীক্ষায় জিপিএ–৪ দশমিক ৮৩ পেয়ে সাধারণ বৃত্তি পান। ২০১৭ সালে মৌলভীবাজার সরকারি উচ্চবিদ্যালয়ে ষষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি হন। ২০২২ সালে এসএসসি পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পেয়ে উত্তীর্ণ হন। এরপর ভর্তি হন মৌলভীবাজার সরকারি কলেজে।

হরিবোল আরও বলেন, দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী হওয়ায় তাঁকে ব্রেইল পদ্ধতিতে পড়তে হতো। এই ধরনের বইগুলো সরকার শুধু মাধ্যমিক পর্যায় পর্যন্ত ছাপায়। উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ের বইগুলো সরকারিভাবে ছাপানো হয় না। পরে মৌলভীবাজার সমন্বিত দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী শিক্ষা কার্যক্রমের আওতায় সমাজসেবা কার্যালয়ের মাধ্যমে পড়াশোনা করেন। এ সময় বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা পান। নবম-দশম শ্রেণিতে থাকতে ব্র্যাকের কর্মকর্তা লিমিয়া দেওয়ান তাঁকে সহায়তা করেন। তিনি তাঁকে স্মার্টফোন কিনে দিয়েছিলেন। ওই ফোনে পড়া রেকর্ড করে তিনি শুনে শুনে মুখস্থ করতেন। এ ছাড়া আমরাইলছড়া চা–বাগানের শিক্ষক আপন দাস তাঁকে পড়ানোর পাশাপাশি বিভিন্ন সংগঠনের মাধ্যমে তাঁকে সহযোগিতা করেছেন। তিনি শ্রুতলেখকদের ওপরও কৃতজ্ঞতা জানান।

মা-বাবার সঙ্গে হরিবোল বোনার্জি
ছবি: প্রথম আলো

হরিবোল প্রথম আলোকে বলেন, সামনে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা। সেই পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছেন। সাধারণ শিক্ষার্থীদের মতো তিনি পড়তে পারেন না। আরেকজন বইপত্র দিয়ে রেকর্ড করে সেটা শুনে শুনে পড়েন। এগুলোর অনেক খরচ। মা-বাবা দুজনেই চা–শ্রমিক। দরিদ্র পরিবারের পক্ষে তাঁর পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়া সম্ভব হচ্ছে না। জন্মান্ধ হওয়ায় তাঁর পক্ষেও কোনো আয়রোজগার করা সম্ভব হচ্ছে না। এমন অবস্থায় ভবিষ্যৎ নিয়ে তিনি শঙ্কায় পড়েছেন। তিনি সমাজের বিত্তবানদের এ ব্যাপারে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান। তিনি বলেন, ‘আমি অনেক দূর পড়াশোনা করতে চাই। থেমে যেতে চাই না।’

বিশখা বলেন, ছেলের যখন জন্ম হয়, পাড়া-প্রতিবেশীরা বলেছিলেন, অন্ধ ছেলে সংসারের বোঝা হবে। বড় হয়ে কিছুই করতে পারবে না। তিনি ছেলেকে অনেক কষ্ট করে বড় করছেন। ছেলের পড়ালেখায় অনেক আগ্রহ। অনেক ভালো রেজাল্ট করেছে, সুস্থ মানুষেরাও করতে পারে না। তিনি ছেলের ভবিষ্যৎ নিয়ে অনেক চিন্তিত। সে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে চায়। কিন্তু তার খরচ চালানোর মতো সামর্থ্য তাঁদের নেই। চা-শ্রমিকের মজুরি দিয়ে কোনোমতে টেনেটুনে সংসার চালান। ভালো ফল করার পরও ছেলে টাকার জন্য পিছিয়ে পড়বে ভাবতে খারাপ লাগে।

অনিল বলেন, ‘এত ভালোভাবে পাস করল। চোখে দেখতে না পারায় আমার ছেলেটা অবহেলিত থেকে যাবে। সরকারের কাছে দাবি জানাই, মেধাবী প্রতিবন্ধীদের চাকরির ব্যবস্থা করে দেন, যেন তারা নিজে কিছু করে খেতে পারে।’