সিলেটে ১০৩ সরকারি কৌঁসুলির তালিকা প্রকাশ, বিএনপি ও জামায়াতের প্রত্যাখান
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকার পতনের ৭৩ দিন পর সিলেট জেলা ও সিলেট মহানগর দায়রা জজ আদালতের ১০৩ জন সরকারি কৌঁসুলির তালিকা প্রকাশ করেছে আইন মন্ত্রণালয়। এর মধ্যে ৯০ জনই বিএনপি-সমর্থিত আইনজীবী হিসেবে পরিচিত। বাকিদের মধ্যে ১২ জন জামায়াত-সমর্থক। এর বাইরে একজন আছেন জাতীয় পার্টি-সমর্থিত।
গতকাল বুধবার রাতে আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের আইন ও বিচার বিভাগের (সলিসিটর উইং) উপসলিসিটর (জিপি-পিপি) সানা মো. মাহরুফ হোসাইন স্বাক্ষরিত এক আদেশে বিষয়টি জানানো হয়। এতে বলা হয়, নিয়োগের আদেশ অবিলম্বে কার্যকর হবে।
এদিকে সরকারি কৌঁসুলি নিয়োগের বিষয়টি নিয়ে আজ বৃহস্পতিবার সকাল থেকে আদালতপাড়ায় অনেক আইনজীবী ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করছেন। বিএনপি ও জামায়াতপন্থী একাধিক আইনজীবীর অভিযোগ, ঘোষিত তালিকায় জ্যেষ্ঠতা লঙ্ঘনের পাশাপাশি প্রবাসী, অযোগ্য ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের বিরোধী ব্যক্তিও ঠাঁই পেয়েছেন। এ তালিকা সংশোধন করা উচিত।
জেলা ও দায়রা জজ আদালতে এ টি এম ফয়েজ উদ্দিন পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন। তিনি ১৯৯৩ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর আইনজীবী সমিতিতে যোগদান করেন। ফয়েজ সিলেট জেলা বিএনপির উপদেষ্টা হিসেবে আছেন। ফয়েজ ছাড়াও এ আদালতে ১৮ জন অতিরিক্ত পাবলিক প্রসিকিউটর ও ৩৫ জন সহকারী পাবলিক প্রসিকিউটর হিসেবে নিয়োগ পান।
জেলা ও দায়রা জজ আদালতে সরকারি কৌঁসুলি (জিপি) হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন শামীম আহমদ সিদ্দিকী। তিনি ১৯৯৬ সালের ১৩ এপ্রিল আইনজীবী সমিতিতে যোগদান করেন। শামীম সিলেট মহানগর বিএনপির সাবেক যুগ্ম সম্পাদক। শামীম ছাড়াও এ আদালতে অতিরিক্ত সরকারি কৌঁসুলি হিসেবে ৮ জন ও সহকারী সরকারি কৌঁসুলি হিসেবে ১৩ জন নিয়োগ পেয়েছেন।
এ ছাড়া মহানগর দায়রা জজ আদালতে বদরুল আহমদ চৌধুরী, বিভাগীয় বিশেষ জজ আদালতে হাসান আহমদ পাটোয়ারী রিপন, সন্ত্রাসবিরোধী বিশেষ ট্রাইব্যুনালে শাহ আশরাফুল ইসলাম আশরাফ, নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে এম মজিবুর রহমান মজিব, দ্রুতবিচার ট্রাইব্যুনালে মো. আবুল হোসেন, সাইবার ট্রাইব্যুনালে মোহাম্মদ এজাজ উদ্দিন এবং জননিরাপত্তা বিঘ্নকারী অপরাধ দমন ট্রাইব্যুনালে মো. মুহিবুর রহমান পাবলিক প্রসিকিউটর হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন। এর বাইরে মানব পাচার অপরাধ দমন ট্রাইব্যুনালে বিশেষ প্রসিকিউটর হিসেবে নিয়োগ পান গিয়াস উদ্দিন চৌধুরী।
মহানগর দায়রা জজ আদালতে সাতজন অতিরিক্ত পাবলিক প্রসিকিউটর ও একজন সহকারী পাবলিক প্রসিকিউটর নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে ১১ জন সহকারী পাবলিক প্রসিকিউটর নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। নতুন নিয়োগপ্রাপ্ত আইন কর্মকর্তাদের মধ্যে দুজন হিন্দুধর্মাবলম্বী রয়েছেন। এ ছাড়া নারী আছেন পাঁচজন।
বিক্ষোভ, প্রতিবাদে স্মারকলিপি
পিপি পদে ফয়েজ উদ্দিনকে প্রত্যাখ্যান করে আজ বেলা দেড়টার দিকে বিএনপিপন্থী আইনজীবীদের সংগঠন জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরাম সিলেট ইউনিট আদালত প্রাঙ্গণে অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ করে। বিক্ষোভকারী আইনজীবীদের দাবি, ফয়েজ দুই বছর ধরে যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী ও বিতর্কিত ব্যক্তি। তাঁরা নবনিযুক্ত পিপি এ টি এম ফয়েজকে পরিবর্তনের দাবি জানান।
অন্যদিকে, জামায়াতপন্থী আইনজীবীদের সংগঠন হিসেবে পরিচিত বাংলাদেশ ল’ ইয়ার্স কাউন্সিল সিলেট শাখা সব সরকারি কৌঁসুলির নিয়োগ বাতিলের দাবি জানিয়ে আইন উপদেষ্টা বরাবর স্মারকলিপি দিয়েছে। সংগঠনটির অভিযোগ, প্রবাসী থেকে শুরু করে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের বিরোধী ব্যক্তিও সরকারি কৌঁসুলি হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন।
জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরাম সিলেট ইউনিটের প্রতিবাদ সমাবেশে সভাপতিত্ব করেন আয়োজক সংগঠনের সাবেক সভাপতি ও জেলা বিএনপির জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি আশিক উদ্দিন আশুক। ফোরামের সাধারণ সম্পাদক বদরুল আহমদ চৌধুরীর সঞ্চালনায় বক্তারা বলেন, ফয়েজ একজন বহুরূপী ও বিতর্কিত ব্যক্তি। তিনি আওয়ামী লীগের রাজনীতি থেকে বিএনপিতে এলেও বিগত ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের দীর্ঘ আন্দোলনে তাঁর ভূমিকা ছিল রহস্যজনক।
প্রতিবাদ সমাবেশে বক্তারা আরও অভিযোগ করেন, বিএনপিতে ফয়েজের সাংগঠনিক নিষ্ক্রিয়তা, অনুপস্থিতি ও দলীয় নেতা-কর্মীদের আইনি সেবা প্রদানে তাঁর বিতর্কিত ভূমিকার কারণে একসময় আইনজীবী ফোরামের সভাপতির পদ থেকে তাঁকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। তিনি দুই বছর আগে যুক্তরাষ্ট্রের অভিবাসী হয়ে সপরিবার স্থায়ীভাবে সেখানে পাড়ি জমান। গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার দেশ ছেড়ে পালানোর পর দেশে ফিরে তিনি পিপি হওয়ার জন্য দৌড়ঝাঁপ শুরু করেন এবং সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের ভুল বুঝিয়ে গুরুত্বপূর্ণ পদটি বাগিয়ে নেন।
সভায় বিএনপিপন্থী আইনজীবীদের মধ্যে হাসান আহমদ পাটোয়ারী (রিপন), আবু তাহের, মোমিনুল ইসলাম, সাইদ আহমদ, এজাজ উদ্দিন, আল আখলাস মুমিন, উবাদুর রহমান ফাহমি, শাহজাহান সিদ্দিকী, আয়েশা সিদ্দিকা, তানভীর আক্তার খান, নজরুল ইসলাম, আবদুল মুকিত (অপি), আলী হায়দার (ফারুক), মিজানুর রহমান চৌধুরী, মাহবুবুর রহমান প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।
প্রতিবাদ সমাবেশ চলাকালে জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরাম সিলেট জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক ও সদ্য নিযুক্ত মহানগর দায়রা জজ আদালতে পিপি বদরুল আহমদ চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, ‘পিপি হিসেবে নিয়োগ পাওয়া ব্যক্তি ফয়েজের পরিবর্তন চাই আমরা। এ ছাড়া নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালসহ আরও তিনজন পিপিও যোগ্য ব্যক্তি হননি। যাঁরা সেখানে নিয়োগ পেয়েছেন, জুলাই-আগস্ট বিপ্লবে তাঁদের কোনো অংশগ্রহণই ছিল না। এ ছাড়া তালিকায় জ্যেষ্ঠতাও লঙ্ঘন করা হয়েছে।
বিএনপিপন্থী আইনজীবীদের অভিযোগ প্রসঙ্গে এ টি এম ফয়েজ সন্ধ্যা সাতটার দিকে প্রথম আলোকে বলেন, ‘চাওয়া না-পাওয়ার বেদনা থেকে ৮ থেকে ১০ জন প্রতিবাদ করছেন। একসময় ছাত্রলীগ, আওয়ামী লীগ করেছি ঠিক। তবে ২২ বছর ধরে বিএনপির রাজনীতিতে ওতপ্রোতভাবে আমি জড়িত।’
এদিকে বাংলাদেশ ল’ ইয়ার্স কাউন্সিল সিলেট শাখা আইন উপদেষ্টা বরাবরে স্মারকলিপি দিয়েছে। আজ দুপুরে সিলেটের জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে তারা এ স্মারকলিপি দেয়। সংগঠনের পক্ষ থেকে স্মারকলিপিতে স্বাক্ষর করেন সিলেট শাখার সভাপতি মো. আলীম উদ্দিন।
স্মারকলিপিতে বলা হয়, প্রকাশিত আইন কর্মকর্তাদের তালিকায় জিপি হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী ব্যক্তিকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া পিপি হিসেবেও যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় প্রবাসে অবস্থানকারী একজনকে নিয়োগ দেওয়া হয়। এ ছাড়া তালিকায় এমন নামও এসেছে, যাঁরা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের বিরোধী ছিলেন এবং ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের দোসর হিসেবে পরিচিত। এ অবস্থায় জিপি ও পিপি তালিকা বাতিল করে আইন পেশায় সৎ, দক্ষ ও যোগ্য ব্যক্তিদের নতুন তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা উচিত।