‘একজন ফোন ধরে বলল, আপনার ছেলের মাথায় গুলি লাগছে’
ইচ্ছা ছিল উচ্চশিক্ষিত হয়ে চাকরি করে সংসারের অভাব দূর করবে। একটি বুলেটে অকালে প্রাণ হারায় কলেজশিক্ষার্থী নাজিম উদ্দিন (১৭)। ৫ আগস্ট দুপুরে রাজধানীর উত্তরা পূর্ব থানা থেকে ছোড়া পুলিশের গুলিতে সে মারা যায়। পরদিন সকালে লাশ গ্রামের বাড়িতে এনে দাফন করা হয়। ছেলের মৃত্যুর পর থেকে আহাজারি থামছেই না মা শিমুলা আক্তারের।
নাজিম নেত্রকোনার বারহাট্টার চিরাম ইউনিয়নের ভাটগাঁও গ্রামের রুস্তম আলীর ছেলে। বারহাট্টা সরকারি কলেজের একাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থী ছিল সে। দুই ভাইবোনের মধ্যে সে ছিল ছোট।
এলাকাবাসী ও স্বজনেরা বলেন, রুস্তম আলীর ভিটেমাটি ছাড়া কিছুই নেই। এক যুগ ধরে পরিবার নিয়ে রাজধানীর উত্তরা আজিমপুর এলাকায় থাকতেন। সেখানে রুস্তম ও তাঁর স্ত্রী একটি সাবান কারখানায় চাকরি করেন। নাজিম গ্রামে নানার বাড়িতে থেকে পড়াশোনা করত। গত ১৬ জুলাই সে বারহাট্টা সরকারি কলেজে ভর্তি হয়। দুই দিন পরে উত্তরায় মা-বাবার কাছে চলে যায়। সেখান থেকে আন্দোলনে গিয়ে পুলিশের গুলিতে মারা যায়।
গত বুধবার দুপুরে ভাটগাঁও গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, ছেলের কবরের পাশে বসে আছেন বাবা রুস্তম আলী। পাশে দাঁড়িয়ে কাঁদছিলেন মা শিমুলা আক্তার ও বোন নাজমা আক্তার। প্রতিবেশীরা তাঁদের সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করছিলেন।
রুস্তম আলী বলেন, ‘আমার একটাই ছেলে আছিন। এইডাই আমার একমাত্র সম্বল। তারে গুলি কইরা মাইরা ফালাইছে। আমার আর কিছু বাকি রইল না। যারা আমার নিষ্পাপ ছেরাডারে মারছে, আমি তাদের বিচার চাই।’
নাজিমের মা শিমুলা আক্তার বলেন, ‘আমরা গরিব মানুষ। থাহনের জায়গাটা ছাড়া কোনো জমিজমা নাই। ঢাহায় ফ্যাক্টরিতে কাম করি। যা পাই তা দিয়া নিজেরা চলি, আর ছেলের পড়াশোনার খরচ চালাই। ছেলেডার স্বপ্ন আছিল পড়াশোনা কইরা শিক্ষিত হইয়া বড় একটা চাকরি করব। সংসারের অভাব দূর হইব। মুহূর্তে আমার সবকিছু শেষ হইয়া গেছে।’
ঘটনার বর্ণনা দিয়ে শিমুলা আক্তার বলেন, ‘আন্দোলন চলার সময় ফ্যাক্টরি বন্ধ আছিল। সবাই বাসায় ছিলাম। ছেলে প্রতিদিনই আন্দোলনে যাইত। ৫ আগস্ট দুপুরে বাইর হইলে কিছুক্ষণ পর আমি মোবাইলে কল দিলে রিসিভ কইরা কইছিল, “আম্মা, আমি একটু পরে আইতাছি। চিন্তা কইরো না।” এটাই শেষ কথা আছিল। পরে বিকেলে কল দিলে একজন ফোন ধইরা কয়, “আপনার ছেলের মাথায় গুলি লাগছে।” আমরা দৌইড়ে যাইয়া উত্তরা পূর্ব থানার সামনে গিয়া দেহি নাজিমরে ঘটনাস্থল থাইক্কা আন্দোলনকারীরা হাসপাতালে লইয়া যাইতাছে। কিন্তু হাসপাতালে গেলে ডাক্তার মৃত ঘোষণা করে।’
নাজিমের চাচা আরব আলী বলেন, ‘খুবই শান্ত ছেলে ছিল নাজিম। যে ক্ষতি হয়েছে, তা কোনো কিছুর বিনিময়ে পূরণ হওয়ার নয়। আল্লাহ তার জান্নাত নসিব করুক।’
বারহাট্টা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ফারজানা আক্তার মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে উপজেলার নাজিম উদ্দিন নামের এক শিক্ষার্থী নিহত হয়েছেন। জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে তাঁর পরিবারকে আগামী রোববার ২৫ হাজার টাকা ও উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ৫০ হাজার টাকার চেক দেওয়া হবে। এ ছাড়া পরিবারটিকে প্রশাসনের পক্ষ থেকে সহযোগিতা করা হবে।