সুনামগঞ্জের ধর্মপাশা উপজেলা সদর থেকে ১৩ কিলোমিটার দূরে সীমের খাল গ্রাম। গ্রামের পূর্বে সোনামড়ল হাওর, পশ্চিমে ররইয়া নদী। বর্ষায় নৌকা ছাড়া যাতায়াতের কোনো উপায় নেই। প্রায় এক যুগ আগে আশপাশের গ্রামের ৩০ থেকে ৩৫টি পরিবার এখানে বসতি গড়ে। ২০২০ সালে এখানকার ৩৪টি পরিবার সরকারি আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘর পায়। এরই একটিতে পরিবার নিয়ে থাকতেন ইঞ্জিনচালিত নৌকাচালক এমারুল মিয়া।
গত সোমবার মধ্যরাতে সেই ঘরে আগুনে এমারুল মিয়াসহ পরিবারের ছয়জনের মৃত্যু হয়েছে। এখন তাঁর ভিটায় বাতি জ্বালানোর মতো কেউ নেই। এর পর থেকেই গ্রামের মানুষের মধ্যে নানা আলোচনা চলছে। ঘটনার আগের দিন এমারুলের ১০ লিটার ডিজেল কেনা, ঘরের ভেতর থেকে দরজা বন্ধ থাকা এবং ঘটনার রাতে মুরগি জবাই করে কাছের মানুষদের নিয়ে খাওয়াদাওয়ার আয়োজন করাসহ নানা প্রশ্ন ঘুরছে গ্রামের মানুষদের মধ্যে। তবে কেউই নিশ্চিত নন, কীভাবে বন্ধ ঘরের ভেতর আগুনের সূত্রপাত হলো।
সীমের খাল গ্রামের মসজিদ কমিটির ক্যাশিয়ার ছিলেন এমারুল। একই কমিটির সভাপতি বাবুল মিয়া (৬৫) বলছিলেন, ‘তার মনের মধ্যে যে কী আবেগ ছিল, হেইডাই বুঝতাছি না। মানুষ তো খারাপ আছিল না। আগুন লাগল, একটা মানুষ বাইরে আইবার চেষ্টা করল না, কিতা করল, কুনতা মাথাত ঢুকতাছে না।’
নৌকা থেকে নেমে দক্ষিণ দিক দিয়ে সীমের খাল গ্রামে ঢোকার মুখে একটি ছোট টিনের চালা ও বেড়ার ঘর। এটি মসজিদ। এরপর আশ্রয়ণ প্রকল্পের সারিবদ্ধ ঘর। ৩ নম্বর ঘরটা এমারুলের। প্রথমটা কামাল মিয়ার। দ্বিতীয়টা দিলফর আলীর। তবে দিলফরের পরিবার ঘর তালা দিয়ে ঢাকায় চলে গেছেন। কামাল প্রতিবেশীর লাশের সঙ্গে গেছেন জেলা সদরে।
এ সময় এগিয়ে আসেন চেরাগ আলী (৬০)। তিনি এমারুলের শ্বশুর, থাকেন একই গ্রামে। আগুনে পোড়া ঘরটি দেখান তিনি। দুই কক্ষের আধা পাকা টিনের ঘর। ঘরের টিন, কাঠ আগুনে ভেঙে পড়েছে। কোনো জিনিসপত্র নেই। সবই পুড়ে ছাই।
চেরাগ আলী জানান, সোমবার বিকেলে এমারুল তাঁর ঘরে গিয়ে রাতে খাওয়ার জন্য দাওয়াত দিয়ে আসেন। সেই রাতে দুটি মুরগি জবাই করে পরিবার ও শ্বশুরবাড়ির লোকজনকে নিয়ে খাওয়াদাওয়া করেন এমারুল। তবে চেরাগ আলী যেতে পারেননি। তাঁর স্ত্রী মরিয়ম বেগম যান এবং মেয়ের ঘরে খাওয়াদাওয়া করেন। মেয়ে পলি বেগম বাবা চেরাগ আলীর জন্য মায়ের কাছে মুরগির মাংসের তরকারি দেন। এই তরকারি দিয়ে খেয়ে রাতে ঘুমিয়ে পড়েন চেরাগ আলী।
চেরাগ আলী বলেন, এরপর রাত ১২টার দিকে কামালের চিৎকার শুনে গিয়ে দেখেন, এমারুলের ঘর দাউ দাউ করে আগুন জ্বলছে। ভেতর থেকে ঘরের দরজা বন্ধ ছিল। আগুনের তাপের কারণে স্টিলের দরজা ভাঙতে পারছিলেন না। গ্রামের সবাই মিলে প্রায় এক ঘণ্টার চেষ্টায় আগুন নেভান। পরে তালা ভেঙে ঘরে ঢুকে দেখেন, সব ছাই হয়ে গেছে। একটি কক্ষে পাঁচজন এবং পাশের কক্ষে একজনের লাশ ছিল। পাশের কক্ষের লাশটা তাঁর ছোট নাতিন ফাতিমার ছিল।
প্রতিবেশীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, এমারুল একটি ইঞ্জিনচালিত নৌকা নিয়ে হাওরে মাছ ধরতেন। ঘটনার আগের দিন ১০ লিটার ডিজেল কিনে এনে ঘরে রেখেছিলেন। তিনি কিছুটা মেজাজি ছিলেন। একসময় চলাফেরা কিছুটা এলোমেলো ছিল। তবে কয়েক বছর ধরে অনেকটা শান্ত। নিজ থেকে এ রকম কোনো অঘটন তিনি ঘটাবেন, এমনটা ভাবতে পারছেন না তাঁরা। তবে একেবারে উড়িয়েও দিচ্ছেন না। পরিবারে টানাপোড়েন ছিল।
চেরাগ আলী বলছিলেন, ‘ইতা কুনতানা। সংসরাও ইতা টুকটাক অখলের থাকে।’
স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের ৪ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য জুয়েল মিয়া বলেন, ‘আমরাও ঘটনা বুঝতে পারছি না কীভাবে ঘটল। আমরাও খোঁজ নিচ্ছি। পুলিশ, প্রশাসনও খোঁজ নিচ্ছে।’
আজ দুপুরে সীমের খাল গ্রামে গিয়ে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ ইলিয়াস মিয়া। এ সময় তিনি মারা যাওয়া এমারুলের আত্মীয়স্বজনের খোঁজ নেন ও স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলেন। জেলা প্রশাসক এমারুলের শ্বশুর চেরাগ আলীকে ২০ হাজার টাকা সহায়তা এবং গ্রামের শিশুদের জন্য পাঁচ হাজার টাকা দেন। এ সময় জেলা প্রশাসকের সঙ্গে ধর্মপাশার ইউএনও মোহাম্মদ গিয়াস উদ্দিন, জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সহকারী কমিশনার এস এম ইয়াসীর আরাফাত, উপপ্রশাসনিক কর্মকর্তা পিন্টু চন্দ্র দাস উপস্থিত ছিলেন।
স্থানীয় বাসিন্দারা জেলা প্রশাসককে জানান, তাঁরা খুবই দরিদ্র মানুষ। মাছ ধরে, শ্রমিকের কাজ করে দিনাতিপাত করেন। হাওরের ঢেউয়ে গ্রামটি ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। গ্রামের পাশের একটি সরকারি পুকুর রয়েছে, সেটিতে মাছ ধরতে বাধা দেন হাওরের ইজারাদারের লোকজন। জেলা প্রশাসক গ্রাম প্রতিরক্ষা দেয়াল নির্মাণ এবং পুকুরটি গ্রামবাসীকে সমিতির মাধ্যমে ইজারা দেওয়ার আশ্বাস দেন।
জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ ইলিয়াস মিয়া বলেন, ‘গ্রামটি দুর্গম হাওর এলাকায় অবস্থিত। কীভাবে আগুনের সূত্রপাত হলো, সেটি জানার চেষ্টা করা হচ্ছে। গ্রামের মানুষেরা দরিদ্র। আমরা তাঁদের জীবনমান উন্নয়নে সহযোগিতা করব।’
আগুনে পুড়ে মারা যাওয়া এমারুল মিয়া (৪৫), তাঁর স্ত্রী পলি আক্তার (৩৫), এই দম্পতির ছেলে পলাশ মিয়া (১০), ফরহাদ মিয়া (৮), ওমর ফারুক (৩) ও মেয়ে ফাতেমা আক্তারের (৫) লাশ ময়নাতদন্তের জন্য বুধবার দুপুরে সুনামগঞ্জ জেলা সদর হাসপাতালে পাঠানো হয়।
সদর হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা মোহাম্মদ রফিকুল ইসলাম বেলা তিনটায় প্রথম আলোকে বলেন, ‘লাশগুলো নিয়ে আসা হয়েছে। আমরা যত দ্রুত সম্ভব ময়নাতদন্তের কাজ সম্পন্ন করে দেব।’