বেড়েছে চুইঝালের চাহিদা, সঙ্গে দামও
যেকোনো মাংসের সঙ্গে কয়েক টুকরা চুইঝাল মাংসের স্বাদ কয়েক গুণ বাড়িয়ে দেয়। বিশেষ করে গরু ও খাসির মাংসের স্বাদ বাড়াতে এর জুড়ি নেই। খুলনায় আসন্ন ঈদুল আজহা উপলক্ষে বেড়ে গেছে চুইঝালের চাহিদা। আর চাহিদা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বেড়েছে দামও।
খুলনা নগরের গল্লামারী বাজারে ১৮ বছরের বেশি সময় ধরে শুধু চুইঝাল বিক্রি করছেন মামুন বিশ্বাস। প্রতিদিন সকালে চুইঝালের পসরা নিয়ে বসেন তিনি। লেখাপড়া ও ব্যবসা একই সঙ্গে চলত। সম্প্রতি পড়াশোনা শেষ করে ব্যবসায় পুরো মনোযোগ দিয়েছেন। গতকাল শুক্রবার সকালে মামুন বিশ্বাস বলেন, চুইঝালের কদর দিন দিন বাড়ছে। বিশেষ করে ঈদের সময় চাহিদা বাড়ে সবচেয়ে বেশি। খুলনা থেকে দেশের বিভিন্ন স্থানে মানুষ চুই নিয়ে যান। অনলাইনেও বিক্রি হচ্ছে দেদার।
মামুন বিশ্বাস বলেন, আগে তাঁরা যে চুই ৮০০ টাকা কেজি দরে বিক্রেতার বাড়ি থেকে পাইকারি দরে কিনে আনতেন, সেই চুই এখন কিনতে হচ্ছে ১ হাজার থেকে ১ হাজার ২০০ টাকায়। তবে মূল চুইয়ের দাম সবচেয়ে বেশি। তাঁর কাছে ১ হাজার ৮০০ টাকা পর্যন্ত কেজি দরের চুইঝাল রয়েছে। মূলত খুলনা, সাতক্ষীরা, বাগেরহাট ও যশোর অঞ্চলের চুইঝালের স্বাদ যেমন বেশি, চাহিদাও তেমন বেশি।
গল্লামারী বাজারের মামুন বিশ্বাসের দোকান থেকে চুইঝাল কিনছিলেন নিরালা আবাসিক এলাকার মাহবুব হোসেন। তিনি বলেন, ‘এখন চুইঝাল ছাড়া গরুর মাংসের তেমন স্বাদই পাই না। প্রতিবছর ঈদের সময় বেশি করে চুইঝাল কিনে রাখি। ঢাকায় থাকা আত্মীয়স্বজনের বাড়িতেও পাঠাতে হয়। এবার দেখছি দামটা বেশ চড়া।’
একই বাজারের সোহরাব হোসেন পান ও বিভিন্ন মসলার সঙ্গে বিক্রি করেন চুইঝাল। তিনি বলেন, হঠাৎ চুইঝালের দাম বাড়িয়ে দিয়েছেন পাইকারি ব্যবসায়ীরা। এ কারণে বাজারে চুইঝালের দাম বেড়েছে। স্থানীয় জাতের যে চুইঝাল আগে প্রতি মণ ২ হাজার ৮০০ টাকায় বিক্রি হতো, এখন তা বিক্রি হচ্ছে ৩ হাজার ৫০০ টাকায়। মোটা ও মূল চুইয়ের দাম সবচেয়ে বেশি।
খুলনা, সাতক্ষীরা ও বাগেরহাটসহ আশপাশের বিভিন্ন জেলার মানুষের কাছে চুইঝাল ব্যাপক জনপ্রিয়। দিন দিন এর জনপ্রিয়তা ছড়িয়ে পড়ছে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্তে। বিক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, চাহিদার শীর্ষে রয়েছে খুলনার বিভিন্ন উপজেলায় উৎপাদিত চুইঝাল। এই চুইঝালের দামও বেশি।
বিক্রেতারা বলেন, চুইঝাল হলো একধরনের মসলাজাতীয় লতানো গাছ। ঝাঁজাল ও প্রচুর ঔষধি গুণসমৃদ্ধ এই গাছের শিকড়, শাখা-প্রশাখা সবই মসলা হিসেবে ব্যবহার করা যায়। ছোট ছোট টুকরা করে মসলার মতো রান্নায় ব্যবহার করা হয়। ভোজনরসিকদের কাছে চুইঝালের মাংস এক অনন্য স্বাদের মাত্রা দেয়। শুধু অনলাইনেই চুইঝাল বিক্রির জন্য গড়ে উঠেছে অনেক প্রতিষ্ঠান।
অনলাইনে দেশের বিভিন্ন স্থানে চুইঝাল বিক্রি করেন খুলনার শরিফুল ইসলাম। অনলাইনে অর্ডার নিয়ে কুরিয়ারের মাধ্যমে ক্রেতার কাছে পৌঁছে দেন তিনি। শরিফুল ইসলাম বলেন, সারা বছরই চুইঝালের চাহিদা রয়েছে। তবে ঈদের সময় চাহিদা অনেক বাড়ে। বিশেষ করে ঢাকাকেন্দ্রিক ক্রেতা বেশি। ক্রেতারা চান ভালো মানের চুইঝাল। সেটিই তাঁদের কাছে পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়। বর্তমানে ভালো মানের চুইঝাল কিনতে খরচ করতে হবে ১ হাজার ২০০ থেকে ১ হাজার ৮০০ টাকা পর্যন্ত।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের (ডিএই) খুলনা আঞ্চলিক কার্যালয়ের তথ্য বলছে, দক্ষিণাঞ্চলীয় খুলনা, বাগেরহাট, সাতক্ষীরা ও নড়াইল জেলায় গত ২০২২-২৩ অর্থবছরে চুইঝাল উৎপাদিত হয়েছে ৫৭৬ টন। এর আগের ২০২১-২২ অর্থবছরে উৎপাদিত হয়েছিল ৩৪৭ টন চুইঝাল। এক অর্থবছরে চুইঝালের উৎপাদন বেড়েছে ২২৯ টন। পাঁচ বছর আগে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে দেশে চুইঝালের মোট উৎপাদন ছিল ২৩৮ টন। অর্থাৎ চুইঝালের উৎপাদন দিন দিন বাড়ছে। বাজারে চাহিদা বৃদ্ধির ফলে কৃষকেরাও বাণিজ্যিকভাবে এটি উৎপাদনে আগ্রহী হচ্ছেন। বদৌলতে গত ছয় বছরে চুইঝালের উৎপাদন বেড়েছে তিন গুণের বেশি।
চুইঝালের কী কী উপকার করে তার একটি তালিকা প্রকাশ করেছে খুলনা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর। ওই তালিকা অনুযায়ী, চুইঝাল শুধু মাংসের স্বাদই বৃদ্ধি করে না, এটি গ্যাস্ট্রিক সমস্যার সমাধান করে ও কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করে। খাবারের রুচি বাড়াতে ও ক্ষুধামান্দ্য দূর করতে কার্যকর ভূমিকা রাখে। পাকস্থলী ও অন্ত্রের প্রদাহ সারাতে চুইঝাল অনেক উপকারী। স্নায়বিক উত্তেজনা ও মানসিক অস্থিরতা প্রশমন করে, ঘুমের ওষুধ হিসেবে কাজ করে এবং শারীরিক দুর্বলতা কাটাতে ও শরীরের ব্যথা নিরাময় করতে কার্যকর ভূমিকা রাখে।