অফিস থেকে ছুটি নিয়ে আন্দোলনে, আর ফেরেননি সেলিম তালুকদার

নিহত সেলিম তালুকদারছবি: সংগৃহীত

১৪ দিন চিকিৎসাধীন থাকার পর ৩১ জুলাই মারা যান বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে গুলিবিদ্ধ সেলিম তালুকদার (৩২)। তাঁর স্ত্রী সুমি আক্তার (১৮) দুই মাসের অন্তঃসত্ত্বা। শুক্রবার ঝালকাঠি শহরের কবিরাজবাড়িতে গিয়ে কথা হয় সুমি আক্তারের সঙ্গে।

পরিবার সূত্রে জানা যায়, সেলিম বিজিএমই ইউনিভার্সিটি অব ফ্যাশন অ্যান্ড টেকনোলজি থেকে দুই বছর আগে স্নাতক সম্পন্ন করে নারায়ণগঞ্জে একটি পোশাক কারখানায় কাজ করতেন। ১৮ জুলাই ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে আন্দোলনে অংশ নিতে গিয়ে তিনি পুলিশের গুলিতে আহত হন। ১৪ দিন পর ৩১ জুলাই ধানমন্ডির পপুলার হাসপাতালের আইসিইউতে তাঁর মৃত্যু হয়। এর পর থেকেই বাবার বাড়ি থাকছেন সুমি। এক বছর আগে তাঁদের বিয়ে হয়েছে। বর্তমানে তিনি দুই মাসের অন্তঃসত্ত্বা।

সেদিনের ঘটনার বর্ণনা দিয়ে সুমি আক্তার বলেন, ‘সেলিম ১৭ জুলাই রাতেই বিজিএমই ইউনিভার্সিটি অব ফ্যাশন অ্যান্ড টেকনোলজির পুরোনো পরিচয়পত্রটি আলমারি থেকে বের করে রাখে। তাকে জিজ্ঞেস করতেই জানায়, “অফিস থেকে ছুটি নিয়েছি। আগামীকাল আন্দোলনে যাব। এই পরিচয়পত্র তখন কাজে লাগবে।” পরদিন ১৮ জুলাই সকালে মধ্য বাড্ডা লিংকরোডের বাসা থেকে বের হয়ে আন্দোলনে যোগ দেয়। সকাল ১০টার দিকে তাকে ফোন দিলে আমি বুঝতে পারি, সে আন্দোলনে আছে। একটু পর আসবে বলে জানায়। সেলিমের আর বাসায় ফেরা হয়নি। বেলা ১১টার দিকে সেলিমের মুঠোফোন থেকে কল করে এক তরুণ গুলিবিদ্ধ হওয়ার কথা জানান। ছাত্ররা তাকে প্রথমে মুগদা হাসপাতালে নেন। খবর পেয়ে আমরা হাসপাতালে ছুটে যাই।’

সেলিম তালুকদারের স্ত্রী ও শ্বশুর মতিউর রহমান
ছবি: প্রথম আলো

সুমি আক্তার বলেন, ‘এক্স-রে ও সিটিস্ক্যানে সেলিমের মাথায় ১৮টি, বুক ও পিঠে ৫৭টি ছররা গুলি পাওয়া যায়। রোগীর অবস্থা খারাপ দেখে আমরা বিভিন্ন হাসপাতালে ঘুরেও আইসিইউ খালি পাইনি। একই সঙ্গে প্রশাসনিক হয়রানির ভয়ে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ রোগী ভর্তি নিতেও অস্বীকৃতি জানায়। অসহায় অবস্থায় ঘুরে ঘুরে ধানমন্ডির পপুলার হাসপাতালের আইসিইউতে ভর্তি করানো হয় সেলিমকে।’

মৃত্যুর পর সনদ নিতে গিয়ে ভয়াবহ পরিস্থিতিতে পড়ে সেলিমের পরিবার। সুমি বলেন, ১ আগস্ট হাসপাতাল থেকে মৃত্যুর সনদ নিতে গিয়ে পুলিশ সকাল থেকে বেলা সাড়ে তিনটা পর্যন্ত লাশ আটক রাখে। স্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছে মর্মে সেলিমের বাবার কাছ থেকে লিখিত নেয়। একপর্যায়ে ময়নাতদন্ত ছাড়াই সেলিমের লাশ নিয়ে আসতে হয়।
সুমি বলেন, ‘আমি দুই মাসের অন্তঃসত্ত্বা। আমাকে সরকারিভাবে কর্মসংস্থানের সুযোগ দিলে অনাগত সন্তানকে নিয়ে ভালোভাবে বেঁচে থাকাতে পারতাম। আমি আমার স্বামী হত্যার সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে ন্যায়বিচার চাই।’

সেলিমের শ্বশুর মতিউর রহমান বলেন, ‘আমার মেয়েটা অল্প বয়সে বিধবা হয়ে গেল। গর্ভে সেলিমের অনাগত সন্তান। আমার মেয়ে এইচএসসি পরীক্ষার্থী। এখন ওর যদি কোনো কর্মসংস্থান হয়, তবে অনাগত সন্তানকে নিয়ে বাঁচার স্বপ্ন দেখতে পারবে।’

এদিকে একমাত্র ছেলেকে হারিয়ে সেলিমের মা-বাবা শোকাহত। সেলিমের বাবা সুলতান তালুকদারের সঙ্গে সুমিদের বাসায় বসে মুঠোফোনে কথা হয়। তিনি বলেন, ‘একমাত্র সন্তানকে হারিয়ে আমরা এখন দিশেহারা। অনাগত সন্তানের মাঝে ওর স্মৃতি ধরে রাখতে চাই। এখন সরকারের কাছে আমাদের দাবি, আমার ছেলে যেন শহীদের তালিকায় স্থান পায়।’