নিজের পড়ালেখা হয়নি, কষ্ট করে পড়ানো ছেলে এখন মেডিকেলের ছাত্র
পড়ালেখা করার প্রতি প্রবল ইচ্ছা ছিল কৃষ্ণ চন্দ্র প্রামাণিকের। কিন্তু দরিদ্র বাবার সন্তান কৃষ্ণকে অষ্টম শ্রেণিতে থাকতেই জীবিকার তাগিদে পড়ালেখায় ইস্তফা দিতে হয়। সেই দুঃখ আজীবন বয়ে বেড়িয়েছেন তিনি। সে জন্য প্রতিজ্ঞা করেছিলেন, নিজের সন্তানদের ঠিকমতো পড়ালেখা করাবেন। তাতে সফলও হয়েছেন চাঁপাইনবাবগঞ্জের নাচোল উপজেলার স্কুলপাড়ার নরসুন্দর কৃষ্ণ চন্দ্র প্রামাণিক। তাঁর ছেলে মিঠুন চন্দ্র প্রামাণিক এবার রাজশাহী মেডিকেল কলেজে এমবিবিএসে ভর্তি হয়েছেন।
ছেলেকে মেডিকেল কলেজে ভর্তি করানোর আনন্দে ভাসছেন কৃষ্ণ চন্দ্র। নাচোল বাসস্ট্যান্ড মোড়ে ছোট একটি সেলুন চালান তিনি। স্বল্প এই আয়ে পাঁচ সদস্যের পরিবার চালাতে হয় তাঁকে। সম্প্রতি তাঁর সেলুনে গিয়ে দেখা যায়, একমনে একজন সেবাগ্রহীতার দাড়ি কাটছিলেন তিনি। এ প্রতিবেদক সেখানে উপস্থিত হতেই তাঁর কাজের গতি বেড়ে যায়। বোঝা যাচ্ছিল, ছেলের গল্প বলার জন্য উদ্গ্রীব হয়ে গিয়েছিলেন তিনি। নিজের গল্প দিয়েই শুরু করেন।
কৃষ্ণ চন্দ্র বলেন, ‘আমি যখন অষ্টম শ্রেণিতে পড়ি, তখন হঠাৎ একদিন বাবা বললেন, “আমি আর তোমার লেখাপড়ার খরচ জোগাতে পারব না। এখন থেকে তোমাকে আয়রোজগারের পথে নামতে হবে।” কথাটা শুনে কেঁদে ফেলেছিলাম। কারণ, আমি স্কুলে যেতে, লেখাপড়া করতে ভালোবাসতাম। আমার কান্না দেখে বাবাও চোখের জল ফেলেছিলেন। কিন্তু বাবার অসহায়ত্বের কথা ভেবে চুল–দাড়ি কাটার কাজ শিখে আয়রোজগারের পথে নেমে পড়ি। কিন্তু পড়তে না পারার কষ্টটা মনে গেঁথে থাকে।’
এরপর নিজের যখন সন্তান হয়, তখন সেই পুরোনো কষ্টের কথা মনে পড়ে বলে জানান কৃষ্ণ চন্দ্র। তিনি বলেন, ‘প্রতিজ্ঞা করি, লেখাপড়া করতে না পারার কষ্টটা আমার সন্তানদের পেতে দেব না। বড় মেয়ে স্নাতকোত্তর পরীক্ষা দিয়েছে নবাবগঞ্জ সরকারি কলেজ থেকে। মেজ মেয়ে প্রতিবন্ধী। ছোট ছেলে মিঠুন চন্দ্র প্রামাণিককে ৯ এপ্রিল ভর্তি করেছি রাজশাহী মেডিকেল কলেজে।’ তিনি বলেন, ‘মিঠুন যেদিন সুযোগ পাওয়ার কথা শুনতে পায়, তাৎক্ষণিক কান্না আসে, কেঁদেছি ছেলেকে বুকে জড়িয়ে ধরে। বাপ-বেটা মিলে কেঁদেছি অনেকক্ষণ। কেন কেঁদেছি জানি না। মনে হয়েছে, এই পৃথিবীতে আমি একজন সুখী ব্যক্তি। আমি একজন গর্বিত পিতা।’ এ গল্প করার সময়ও চোখ ভিজে যায় কৃষ্ণ চন্দ্রের।
ছেলের মেডিকেল কলেজে ভর্তির সুযোগ পাওয়ার খবরে অনেকে কৃষ্ণ চন্দ্রকে বাহবা দিতে এসেছেন। তাঁদের মধ্যে স্কুল-কলেজের বেশ কয়েকজন শিক্ষকও আছেন। কষ্ট করে সন্তানদের লেখাপড়া করান বলে কৃষ্ণ চন্দ্রকে পছন্দ করেন অনেকে। কৃষ্ণ বলেন, রাজশাহীতে থেকে পড়ার সময় ছেলের প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষকদের মধ্যে কেউ কেউ প্রায়ই আর্থিক সহায়তা দিতেন। এ ছাড়া ছেলে ছোটবেলা থেকেই টিউশনি করিয়ে আয় করতেন। তবে নতুন করে মেডিকেল কলেজে ভর্তি হওয়ায় বেশ কিছু খরচ নিয়ে দুশ্চিন্তা আছে দরিদ্র এই পিতার।
গল্পের ফাঁকেই বাবার সেলুনে আসেন মিঠুন চন্দ্র প্রামাণিক। তিনি বলেন, ছোটবেলা থেকেই তাঁর মনে লেখাপড়ার প্রতি আগ্রহ ও ভালোবাসার সৃষ্টি করেছেন বাবা। তা না হলে এ পর্যায়ে আসা সম্ভব হতো না। শিক্ষানুরাগী বাবাকে নিয়ে নিজের গর্বের কথা জানান মিঠুন। তিনি বলেন, ‘কষ্ট করে লেখাপড়া করার সময় বাবার মুখটা চোখের সামনে ভেসে আসত। তখন কোনো কষ্টকেই আর কষ্ট মনে হতো না।’