দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের শেষ মুহূর্তেই প্রচারণায় ব্যস্ত সময় পার করছেন প্রার্থীরা। তফসিল অনুযায়ী কাল শুক্রবার সকাল আটটা পর্যন্ত প্রচারণা চালাতে পারবেন। এমন পরিস্থিতিতে নির্বাচনী প্রচারণা ফেলে আচরণবিধি লঙ্ঘনের ঘটনায় মামলা-শোকজে আদালতে ঘুরছেন ঝিনাইদহ-১ (শৈলকুপা) আসনের আওয়ামী লীগের প্রার্থী সংসদ সদস্য আবদুল হাইসহ তাঁর অনুসারী নেতা-কর্মীরা। কখনো এলাকা ছেড়ে উচ্চ আদালতে গিয়ে জামিন নিচ্ছেন। কখনো নিম্ন আদালতে হাজির হতে না পারায় জারি হচ্ছে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা।
আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মী ও সমর্থকদের দাবি, তাঁরা আচরণবিধি মেনেই প্রচারণা চালিয়েছেন। কিন্তু একটি মহলের অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে নির্বাচন কমিশন (ইসি) তাঁদের শোকজ করছে, মামলা দিচ্ছে। এতে প্রচারণা ফেলে তাঁদের আদালতে ছুটতে হচ্ছে। সাধারণ ভোটাররা বলছেন, শৈলকুপায় ভোট নিয়ে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ-খুনোখুনির নজির আছে। ইসির পদক্ষেপে এবার এখনো তেমন কোনো ঘটনা ঘটেনি। ছোটখাটো ঘটনায় ইসি ব্যবস্থা নেওয়ায় স্বস্তিতে আছেন ভোটাররা।
জেলা নির্বাচন কার্যালয় সূত্র জানায়, নির্বাচনে প্রতীক বরাদ্দের পর থেকে গতকাল বুধবার পর্যন্ত ঝিনাইদহ-১ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী আবদুল হাইসহ কর্মী-সমর্থকদের বিরুদ্ধে মোট পাঁচটি মামলা করেছে নির্বাচন কমিশন। এর মধ্যে ২৪ ডিসেম্বর দুটি মামলা করা হয়। দুটি মামলায় আবদুল হাইকে আসামি করা হয়েছে। একটি মামলায় আবদুল হাইয়ের সঙ্গে শৈলকুপা উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আবদুল হাকিম ও সারুটিয়া ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান মাহমুদুল হাসান আসামি হয়েছেন। এ ছাড়া ২ জানুয়ারি তিনটি মামলা হয়েছে। এর মধ্যে একটি মামলায় আবদুল হাই, আরেকটি মামলায় উপজেলা চেয়ারম্যান আবদুল হাকিম, হাকিমপুর ইউপির চেয়ারম্যান ইকু সিকদার ও শৈলকুপা উপজেলা যুবলীগের সভাপতি শামীম হোসেন মোল্লাকে আসামি। অন্য মামলায় ফুলহরি ইউপির সাবেক চেয়ারম্যান ও জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য জামিনুর রহমানকে আসামি করা হয়েছে। তাঁরা সবাই আবদুল হাইয়ের সক্রিয় কর্মী।
শৈলকুপার ১৪টি ইউনিয়ন ও একটি পৌরসভা নিয়ে গঠিত ঝিনাইদহ-১ আসনে এবার ছয়জন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। তাঁরা হলেন আওয়ামী লীগের প্রার্থী ও জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আবদুল হাই (নৌকা), স্বতন্ত্র প্রার্থী ও জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি নজরুল ইসলাম (ট্রাক), তাঁর স্ত্রী মুনিয়া আফরিন (ফুলকপি), জাতীয় পার্টির মনিকা আলম (লাঙ্গল), তৃণমূল বিএনপির কে এম জাহাঙ্গীর মজমাদার (সোনালী আঁশ) ও ন্যাশনাল পিপলস পার্টির মো. আনিচুর রহমান (আম)। আসনের মোট ভোটার ৩ লাখ ৬ হাজার ৩৩৬। এর মধ্যে পুরুষ ভোটার ১ লাখ ৫৩ হাজার ৫৭৭ আর নারী ভোটার ১ লাখ ৫২ হাজার ৭৫৯।
সূত্র জানায়, নৌকার কর্মী-সমর্থকদের বিরুদ্ধে নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে মামলা করা হলেও নজরুলের অনুসারীদের বিরুদ্ধে শুধু শোকজ করা হয়। এর মধ্যে নজরুল ইসলামকে দুবার শোকজ ও তাঁর প্রধান নির্বাচনী এজেন্ট শৈলকুপা পৌরসভার মেয়র কাজী আশরাফুল আজম ও কর্মী কামাল হোসেনকে শোকজ করা হয়েছে।
জেলা জ্যেষ্ঠ নির্বাচন কর্মকর্তা মো. রোকনুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, ২৪ ডিসেম্বর প্রথমে সংসদ সদস্য আবদুল হাইয়ের বিরুদ্ধে দুটি ও তাঁর দুই কর্মীর বিরুদ্ধে একটি করে মামলা করা হয় আদালতে। এরপর ২ জানুয়ারি আবদুল হাই ও তাঁর তিন কর্মীর বিরুদ্ধে আরেকটি মামলা হয়। আচরণবিধি লঙ্ঘনের অভিযোগ পেয়ে নির্বাচনী অনুসন্ধান কমিটি তদন্ত করে প্রাথমিক প্রমাণ পাওয়ার পর মামলা হয়েছে। নির্বাচন কমিশনের নির্দেশেই মামলা হয়েছে। এ ছাড়া যাঁদের বিরুদ্ধে শোকজ করা হয়েছে, সেগুলো নির্বাচনের পরিবেশ ভালো রাখতেই করা হয়েছে।
শৈলকুপা উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও নৌকা প্রতীকের প্রধান এজেন্ট আবদুল হাকিম প্রথম আলোকে বলেন, তাঁরা আচরণবিধি মেনেই ভোটের মাঠে কাজ করে যাচ্ছেন। একটি মহলের অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে তাঁদের বিরুদ্ধে একের পর এক শোকজ-মামলা দেওয়া হচ্ছে। তাঁরা আইনের প্রতি আস্থা রেখে ইতিমধ্যে সব মামলায় জামিন নিয়েছেন। তিনি বলেন, মামলার কারণে তাঁদের অনেকটা সময় ব্যয় করতে হচ্ছে আদালতের বারান্দায়, যে সময়টা তাঁরা ভোটারদের কাছে ব্যয় করতে পারতেন।
বুধবার সরেজমিনে শৈলকুপায় বিভিন্ন এলাকা ঘুরে ভোটারদের মধ্যে নির্বাচনের পরিবেশ নিয়ে স্বস্তির কথা জানা গেল। ইসির পদক্ষেপে ভোটারদের অনেকেই সন্তুষ্ট। শৈলকুপা বাজারের ব্যবসায়ী মিজানুর রহমান বলেন, শৈলকুপায় নির্বাচনে পেশিশক্তির প্রয়োগ দেখা যায়। তাঁরা সব সময় শঙ্কিত থাকেন। অন্যবারের তুলনায় এবার পরিবেশ অনেক ভালো। থানা এলাকার বাসিন্দা আলমঙ্গীর হোসেনের ভাষ্য, গত ইউপি নির্বাচনে সারুটিয়া ইউনিয়নে ছয়জন খুন হয়েছিল। সেই তুলনায় এবার তেমন কিছুই ঘটেনি। নির্বাচন কমিশনের তৎপরতায় এটা সম্ভব হয়েছে। সাধারণ ভোটাররা এখন অনেক স্বস্তিতে আছেন।
অবশ্য নৌকার সমর্থক কবিরপুরের আবদুল জলিল বলেন, নির্বাচন কমিশনের পদক্ষেপ তাঁদের (নৌকা) প্রার্থীর বিপক্ষেই বেশি হচ্ছে। জেলার অন্য কোথাও প্রার্থীর বিরুদ্ধে মামলা দেওয়া হয়নি। এখানে নৌকার প্রার্থীর বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। তিনি বলেন, বর্তমানে নৌকার প্রার্থী ও তাঁর কর্মীদের বেশ কয়েকজনকে আদালতের বারান্দায় ঘুরতে হচ্ছে। বুধবার তাঁরা ঢাকায় উচ্চ আদালতে জামিনের জন্য ছিলেন। আজ ঝিনাইদহের আদালত থেকে জামিন নিয়েছেন।