আমের বীজের ব্যাকটেরিয়া প্রতিরোধী উপাদান পেলেন বাকৃবির একদল গবেষক
মানুষের পাশাপাশি প্রাণীর ব্যাকটেরিয়াজনিত রোগের চিকিৎসায় অ্যান্টিবায়োটিকই প্রধান ভরসা। তবে অনেক ব্যাকটেরিয়া বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদিত সিনথেটিক অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল এজেন্টের (অ্যান্টিবায়োটিক) প্রতি প্রতিরোধ গড়ে তুলছে। বিশ্বব্যাপী অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী ব্যাকটেরিয়ার কারণে বাড়তে থাকা ঝুঁকি জনস্বাস্থ্যে বড় হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। এমন অবস্থায় আমের বীজে অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল কার্যকারিতা খুঁজে পেয়েছেন বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাকৃবি) একদল গবেষক।
গবেষক দলটি বলছে, সিনথেটিক অ্যান্টিবায়োটিকের বিকল্প হিসেবে এই প্রাকৃতিক উপাদান ব্যবহার সম্ভব; যার মাধ্যমে ব্যাকটেরিয়াজনিত রোগের চিকিৎসায় নতুন সম্ভাবনার দিগন্ত উন্মোচন হবে। তবে আমের বীজের ঠিক কোন উপাদানের জন্য এটি ব্যাকটেরিয়ার বিরুদ্ধে কাজ করে, সেটি নির্ধারণের জন্য উচ্চতর গবেষণার প্রয়োজন।
২০২৩ সালের এপ্রিলে শুরু হওয়া এই গবেষণায় নেতৃত্ব দিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের মাইক্রোবায়োলজি অ্যান্ড হাইজিন বিভাগের অধ্যাপক মো. গোলজার হোসেন। এ পর্যন্ত গবেষকের নিজস্ব অর্থায়নেই গবেষণার কাজটি পরিচালিত হয়েছে। গবেষক দলে আরও ছিলেন মাইক্রোবায়োলজি অ্যান্ড হাইজিন বিভাগের অধ্যাপক সুকুমার সাহা, ফিজিওলজি বিভাগের অধ্যাপক শারমিন আক্তার, কৃষি রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক বিপ্লব কুমার সাহা, একই বিভাগের স্নাতকোত্তরের শিক্ষার্থী রাহীলা জান্নাত সাদিয়া, চন্দন সিকদার, আনন্দ মজুমদার, মোসলেমা জাহান ও নাজমুল হাসান।
আজ সোমবার বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় সাংবাদিক সমিতির কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত সংবাদ সম্মেলনে গবেষণার প্রাথমিক ফলাফল উপস্থাপন করেন প্রধান গবেষক মো. গোলজার হোসেন। এ সময় উপস্থিত ছিলেন মাইক্রোবায়োলজি অ্যান্ড হাইজিন বিভাগের প্রধান অধ্যাপক কে এইচ এম নাজমুল হুসাইন, একই বিভাগের অধ্যাপক সুকুমার সাহা, ফিজিওলজি বিভাগের অধ্যাপক শারমিন আক্তারসহ গবেষণার কাজের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট স্নাতকোত্তর শিক্ষার্থীরা। গবেষণার প্রাথমিক ফল একটি বৈজ্ঞানিক জার্নালের জন্য গৃহীত হয়েছে বলে সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়।
অধ্যাপক মো. গোলজার হোসেন বলেন, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী ব্যাকটেরিয়াকে জনস্বাস্থ্যের জন্য একটি আন্তর্জাতিক সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করেছে। বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, ভেষজ ওষুধগুলো সিনথেটিক ওষুধের চেয়ে নিরাপদ, সুবিধাজনক ও সাশ্রয়ী। তবে বাংলাদেশে এ নিয়ে তেমন কোনো গবেষণা হয়নি। এ কারণেই ভেষজ উপাদান থেকে অ্যান্টিবায়োটিক তৈরির গবেষণার ওপর গুরুত্ব দিয়ে কাজ শুরু করা হয়। বাংলাদেশে প্রচুর পরিমাণে আম উৎপাদিত হয় এবং এর বীজ সাধারণত ফেলে দেওয়া হয়। এই বীজকে কোনোভাবে কাজে লাগানো যায় কি না, সেটি দেখার জন্য বীজ থেকে একটি নির্যাস তৈরি করা হয়।
গবেষণার ফল নিয়ে প্রধান গবেষক জানান, এই নির্যাস পর্যবেক্ষণ করে দেখা গেছে যে এটি কিছু ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়ার বিরুদ্ধে কার্যকর। এরপর ব্যাকটেরিয়া দ্বারা আক্রান্ত ইঁদুরের ওপর এই নির্যাস প্রয়োগ করলে দেখা যায়, এই নির্যাস ওই সব ব্যাকটেরিয়ার কোষ ধ্বংস করতে সক্ষম। পাশাপাশি এটি ব্যাকটেরিয়া দ্বারা তৈরি বায়োফিল্মও ধ্বংস করতে পারে। তবে উচ্চমাত্রায় এই নির্যাস প্রয়োগে ইঁদুরগুলোর যকৃৎ (লিভার) ও বৃক্কে (কিডনিতে) সামান্য পরিবর্তন দেখা গেলেও উল্লেখযোগ্য কোনো খারাপ লক্ষণ দেখা যায়নি। অর্থাৎ এই নির্যাসে তেমন কোনো বিষাক্ত উপাদান নেই বললেই চলে। তবে বীজের ঠিক কোন উপাদানের জন্য এটি ব্যাকটেরিয়ার বিরুদ্ধে কাজ করে, সেটি নির্ধারণের জন্য উচ্চতর গবেষণার প্রয়োজন।
আমের বীজে উপস্থিত অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল উপাদান প্রয়োগের ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা নিয়ে প্রধান গবেষক জানান, বর্তমানে প্রাথমিকভাবে পোলট্রি মুরগিতে এই নির্যাস প্রয়োগের কাজ শুরু করা হয়েছে। এই নির্যাস দিয়ে পোলট্রি মুরগির ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণ রোধ করা গেলে এটি বাংলাদেশের পোলট্রি ও স্বাস্থ্য খাতে দৃশ্যমান অবদান রাখবে। এতে অর্থনৈতিক সাশ্রয় হবে, যা জাতীয় উন্নয়নেও সহায়ক হবে।
সংবাদ সম্মেলনে অধ্যাপক সুকুমার সাহা বলেন, আমের বীজের ওই সক্রিয় উপাদানটি বের করার জন্য এখন উচ্চতর গবেষণা করতে হবে। যে সক্রিয় উপাদানটি ব্যাকটেরিয়াকে ধ্বংস করেছে, সেটি যদি চিহ্নিত করা যায়, তবে বর্তমানে এই প্রাথমিক নির্যাসের যে বিষাক্ততা আছে, সেটির প্রায় ৯৯ দশমিক ৯৯ ভাগ দূরীভূত হবে।