কুমিল্লার দেবীদ্বারে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পর মাথায় গুলিবিদ্ধ হয়ে গুরুতর আহত হওয়া সাব্বির হোসেন (১৮) ৪০ দিন মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ে মারা গেছেন।
শনিবার সকাল সাড়ে ৯টার দিকে দেবীদ্বারের ভিংলাবাড়ি এলাকায় নানাবাড়িতে তাঁর মৃত্যু হয়। কয়েকটি হাসপাতালে চিকিৎসার পর অস্ত্রোপচার শেষে গতকাল শুক্রবার ঢাকা থেকে বাড়িতে নেওয়া হয়।
বাবাহারা সাব্বির ছিলেন সংসারের একমাত্র আশার আলো। ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা চালিয়ে মাসহ চারজনের সংসার চালাতেন। তাঁকে হারিয়ে পরিবারটি এখন দিশাহারা।
গণ–আন্দোলনের মুখে গত ৫ আগস্ট প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে শেখ হাসিনার পদত্যাগ ও দেশত্যাগের পর বিকেলে বিজয় মিছিল নিয়ে দেবীদ্বার থানা ঘেরাওয়ের সময় পুলিশের গুলিতে আহত হন তিনি। তবে পুলিশের দাবি, দেবীদ্বার নিউমার্কেট গোলচত্বর এলাকায় ছাত্রলীগ ও যুবলীগের হামলায় তিনি গুলিবিদ্ধ হন।
নিহত সাব্বিরের বাড়ি পাশের মুরাদনগর উপজেলার কাজিয়াতল এলাকায় হলেও ছোটবেলা থেকে তিনি মায়ের সঙ্গে নানাবাড়িতে থাকতেন। তিন ভাই–বোনের মধ্যে সাব্বির সবার বড়। বাবার মৃত্যুর পর সংসারের হাল ধরতে অটোরিকশা চালানো শুরু করেন তিনি।
ছেলের মৃত্যুর পর থেকে সাব্বিরের মা রীনা বেগমের কান্না থামছেই না। বিলাপ করতে করতে বারবার মূর্ছা যাচ্ছেন মা রীনা বেগম। পাড়া-প্রতিবেশীরা তাঁকে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করছেন। রীনা বেগম বলেন, ‘দুই বছর আগে স্বামীরে হারাইছি। বড় পোলা সাব্বিরের তখন এসএসসি পরীক্ষা দেওনের কথা আছিল। বাপ মারা যাওয়ায় পোলাডা আমার আর পরীক্ষা দেয় নাই। ছোড দুইডা ভাইবইন আর আমারে ভালো রাখার লাইগ্যা অটোরিকশা লইয়া রাস্তায় নামছে। তারা আমার পোলাডার মাথায় গুলি করছে। পোলাডা আমার ৪০টা দিন কষ্টে ছটফট করেছে।’
স্বজন ও এলাকাবাসী জানান, ৫ আগস্ট বিকেলে বিজয় মিছিল নিয়ে দেবীদ্বার থানা ঘেরাও করেন আন্দোলনকারীরা। পুলিশ থানার ছাদে উঠে আন্দোলনকারীদের ওপর এলোপাতাড়ি গুলি করলে ১৫ থেকে ১৬ জন গুলিবিদ্ধ হন। এ সময় সাব্বিরের মাথাসহ শরীরের বিভিন্ন অংশে গুলি লাগে। তাঁকে উদ্ধার করে প্রথমে মুরাদনগর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ও পরে কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়। এরপর ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ঘুরে সর্বশেষ রাজধানীর গ্রিন লাইফ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন। অস্ত্রোপচারের পর কিছুটা সুস্থ হলে গতকাল সকালে তাঁকে বাড়িতে নিয়ে যান স্বজনেরা। আজ সকাল সাড়ে ৯টার দিকে বাড়িতে হঠাৎ মাথা ঘুরে পড়ে যান। পরে তাঁকে দ্রুত দেবীদ্বার উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে গেলে চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন। খবর পেয়ে পুলিশ তাঁর লাশ উদ্ধার করতে গেলে এলাকাবাসী বাধা দেন। পরে ময়নাতদন্ত ছাড়াই লাশ দাফনের অনুমতি দিয়ে থানায় ফিরে আসে পুলিশ।
তবে নাম প্রকাশ না করার শর্তে পুলিশের একাধিক সদস্য দাবি করেন, ৫ আগস্ট দেবীদ্বার নিউমার্কেট গোলচত্বর এলাকায় ছাত্র-জনতার মিছিলে ছাত্রলীগ ও যুবলীগের নেতা-কর্মীরা গুলিবর্ষণ করেন। তখন গুলিবিদ্ধ হন সাব্বির। তবে পরিবারের সদস্যরা পুলিশের এই দাবি ভিত্তিহীন বলে উড়িয়ে দিয়েছেন।
কুমিল্লা উত্তর জেলা ছাত্রদলের সদস্যসচিব মাহমুদুল হাসান প্রথম আলোর কাছে দাবি করেন, ‘সাব্বির আমাদের দলের একনিষ্ঠ কর্মী ছিলেন। দলীয় পদ-পদবি না থাকলেও আমাদের প্রতিটি প্রোগ্রামে অংশ নিতেন। আমাদের কাছে তাঁর ছবি আছে। তিনি ছাত্র আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে মাঠে ছিলেন। আমরা তাঁর হত্যার বিচার চাই। দলীয়ভাবে আমরা তাঁর পরিবারের পাশে দাঁড়ানোর চেষ্টা করব।’
দেবীদ্বার থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) রফিকুল ইসলাম বলেন, সুরতহাল তৈরি ও ময়নাতদন্তের জন্য লাশ উদ্ধার করতে গেলে স্থানীয় লোকজন বাধা দেন। এলাকাবাসী ময়নাতদন্ত ছাড়াই লাশ দাফন করবেন বলে জানিয়েছেন। ঘটনাস্থলে যাওয়া দেবীদ্বার থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মো. শাহিনুল ইসলাম বলেন, এলাকাবাসী বাধা দিলে পরে তাঁরা বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের জানান। এরপর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নির্দেশে লাশ দাফনের অনুমতি দিয়ে থানায় ফিরে আসেন।