চার দাবিতে বরিশাল মেডিকেলে ইন্টার্ন চিকিৎসকদের কর্মবিরতি, সেবা ব্যাহত
চার দফা দাবিতে বরিশালের শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আজ শনিবার দুপুর থেকে কর্মবিরতি পালন করা শুরু করেছেন ইন্টার্ন চিকিৎসকেরা। এতে হাসপাতালের সেবা কার্যক্রম মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে। হাসপাতালে চিকিৎসাধীন এক শিশুর মৃত্যুকে কেন্দ্র করে চিকিৎসক ও নার্সদের লাঞ্ছিত করার প্রতিবাদে ইন্টার্ন চিকিৎসকেরা এ কর্মসূচি শুরু করেন। তাঁদের দাবির প্রতি একাত্মতা জানিয়ে মধ্যম সারির চিকিৎসকেরাও কর্মবিরতিতে যাওয়ার হুমকি দিয়েছেন।
হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানায়, গতকাল শুক্রবার সন্ধ্যায় হাসপাতালের শিশু ওয়ার্ডে মো. জুনায়েদ (৮) নামের এক শিশু মারা যায়। শিশুটি নিউমোনিয়াসহ নানা রোগে আক্রান্ত হয়ে ২৪ সেপ্টেম্বর হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিল। চিকিৎসাধীন অবস্থায় শিশুটির মৃত্যু হলে সাথী আক্তার নামে শিশুটির এক স্বজন চিকিৎসক ও নার্সদের গালিগালাজ ও লাঞ্ছিত করেন। এ ঘটনায় হাসপাতালের ওয়ার্ড মাস্টার আবুল কালাম বাদী হয়ে গতকাল রাতে একটি মামলা করেছেন। এ ঘটনার প্রতিবাদে আজ দুপুর ১২টা থেকে ইন্টার্ন চিকিৎসকেরা কর্মবিরতি শুরু করেন।
এর আগে সকালে বিষয়টি নিয়ে আলোচনার জন্য ইন্টার্ন চিকিৎসকদের সঙ্গে বৈঠকে বসে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। হাসপাতালের তৃতীয় তলায় ওই বৈঠকে হাসপাতালের পরিচালক ছাড়াও সেনাবাহিনীর দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা, মহানগর পুলিশের কর্মকর্তা ও জেলা প্রশাসনের একজন প্রতিনিধি অংশ নেন। বৈঠকে ইন্টার্ন চিকিৎসকেরা চার দফা দাবি তুলে ধরে বাস্তবায়নের দাবি জানান। এ সময় হাসপাতালের পরিচালক সাইফুল ইসলাম দাবি মেনে নেওয়ার আশ্বাস দেন এবং প্রশাসনের সঙ্গে আলোচনা করে বাস্তবায়নের কথা জানান। কিন্তু ইন্টার্ন চিকিৎসকেরা পরিচালকের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে তাৎক্ষণিকভাবে বাস্তবায়ন কিংবা এ–সংক্রান্ত লিখিত চান। লিখিত না দেওয়ায় ইন্টার্ন চিকিৎসকেরা কর্মবিরতি শুরু করেন।
ইন্টার্ন চিকিৎসকদের চার দফা দাবি হলো অপরাধীদের আজকের মধ্যে গ্রেপ্তার, হাসপাতালে ২৪ ঘণ্টা নিরাপত্তায় আনসার সদস্যদের সংখ্যা তিন গুণ বৃদ্ধি ও কমপক্ষে ৩০ জন পুলিশ সদস্য রাখা; শয্যার অতিরিক্ত রোগী ভর্তি বন্ধ করা এবং একজন রোগীর সঙ্গে একজন স্বজন রাখা ও চিকিৎসক সুরক্ষা আইন প্রণয়ন করা। আগামী ২৪ ঘণ্টার মধ্যে দাবি পূরণ না করলে রোববার আরও কঠোর আন্দোলনের ঘোষণা দেবেন বলে হুঁশিয়ারি দেন দেন ইন্টার্ন চিকিৎসকেরা।
ইন্টার্ন চিকিৎসক মাহিউর রহমান ও নূরে আলম বলেন, হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রোগীর মৃত্যুর ঘটনা নিয়ে প্রায়ই চিকিৎসক-নার্সরা হামলার শিকার হচ্ছেন। প্রতিবার তাঁরা সমাধান চেয়েছেন। কিন্তু বারবার পরিচালক তাঁদের আশ্বাস দিয়েছেন। পরে আর দাবি বাস্তবায়িত হয়নি। এ জন্য তাঁরা পরিচালকের কাছে আজই দাবি বাস্তবায়ন অথবা লিখিত চেয়েছেন। কিন্তু তিনি দিতে চাননি। বাধ্য হয়ে তাঁরা কর্মবিরতিতে গেছেন। তাঁরা বলেন, ‘আমরাও চাই না সাধারণ ও গরিব রোগীরা সেবাবঞ্চিত হোক। কিন্তু আমরা তো পড়াশোনা করতে এসে মানুষের সেবা দিচ্ছি। সেখানে প্রতিনিয়ত হামলা হলে কি সেবা দেওয়া সম্ভব?’
হাসপাতালের সেবা ব্যাহত
এদিকে ইন্টার্ন চিকিৎসকেরা কর্মবিরতিতে যাওয়ায় হাসপাতালের চিকিৎসাসেবা মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে। বিশেষ করে বিভিন্ন বিভাগে ভর্তি হওয়া রোগীরা তাৎক্ষণিক সেবা পাচ্ছেন না। এতে রোগীদের ভোগান্তি বেড়েছে।
মেডিসিন বিভাগ ঘুরে দেখা গেছে, রোগীদের ভিড়ে ঠাসা। একজন রোগীর স্বজন নাম প্রকাশ না করে বলেন, স্বামীকে নিয়ে চার দিন ধরে হাসপাতালে আছেন। আগে দিনে-রাতে যখনই সমস্যা হয়েছে, চিকিৎসকদের কক্ষে গিয়ে সমস্যার কথা জানালে তাঁরা বিভিন্ন পরামর্শ দিতেন। কিন্তু আজ সকাল থেকে রোগীরা কোনো চিকিৎসকের দেখা পাচ্ছেন না। এতে চরম ভোগান্তিতে পড়েছেন।
বিভাগের সবচেয়ে বড় হাসপাতাল শের-ই-বাংলা মেডিকেলে কলেজ হাসপাতাল। হাসপাতালটি ৫০০ থেকে ১০০০ শয্যায় উন্নীত হলেও এখনো আগের জনবল কাঠামোতেই চলছে। পুরোনো জনবল কাঠামোর অনুকূলে যে চিকিৎসক পদ থাকার কথা, তার অর্ধেকের কম চিকিৎসক দিয়ে বছরের পর বছর খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলছে। হাসপাতালে প্রতিদিন গড়ে দুই হাজার রোগী ভর্তি থাকেন। বিভাগের ছয় জেলা ছাড়াও পাশের মাদারীপুর ও অন্য জেলা থেকেও অনেক রোগী হাসপাতালে আসেন। এ ছাড়া বহির্বিভাগে প্রতিদিন অন্তত দুই থেকে আড়াই হাজার রোগী সেবা নিতে আসেন।
জানতে চাইলে হাসপাতালের উপপরিচালক মো. মনিরুজ্জামান শাহিন প্রথম আলোকে বলেন, ইন্টার্ন চিকিৎসকেরা কর্মবিরতিতে আছেন। মিড-লেভেলের চিকিৎসকেরাও কর্মবিরতির হুমকি দিচ্ছেন। তাঁরা দাবির তাৎক্ষণিক বাস্তবায়ন চান। আশ্বাস দেওয়াতেও তাঁরা রাজি হননি। সেবা ব্যাহতের বিষয়ে বলেন, ‘হাসপাতালের জরুরি বিভাগের সেবা চলছে। হাসপাতাল তো আর বন্ধ রাখা যাবে না। এ জন্য আমরা হাসপাতালের প্রতিটি বিভাগের প্রধানদের চিঠি দিয়ে নির্দেশনা দিয়েছি যাতে মিড-লেভেলের চিকিৎসকদের দিয়ে সেবা অব্যাহত রাখা হয়।’
মনিরুজ্জামান শাহিন বলেন, ‘আমরা অনেক সীমাবদ্ধতার মধ্যেই কাজ করি। এটা বাস্তবতা। এটা মেনে নিয়েই আমাদের চলতে হবে। এটা সবাইকে বুঝতে হবে এবং ধৈর্য ধরতে হবে। তাই পরিস্থিতি যা–ই হোক না কেন, হাসপাতালের সেবা ব্যাহত হতে দেওয়া যাবে না। আমরা চেষ্টা করছি, যাতে দ্রুত সময়ের মধ্যে ইন্টার্ন চিকিৎসকেরা কাজে ফিরে আসেন।’