ঠেকায় পড়ে কামারের কাজ করেন সৌরভ

বরিশাল নগরের চৌমাথা বাজারে নবগ্রাম খালের পাড়ে ছাপরায় সৌরভ দাসের দোকানছবি: প্রথম আলো

ছাপরায় সৌরভ দাসের (৩৫) দোকান। পেশায় তিনি কামার। কাছে যেতেই  উঠে দাঁড়ালেন সৌরভ। বললেন, ‘বসেন, বসেন, কিছু লাগবে?’  মুখে তাঁর হাসি ফুটে উঠল। কিন্তু ‘না’ সূচক জবাব শুনে সেই হাসি মিলিয়ে গেল।

সৌরভ জানালেন, এই পেশায় এখন আর টিকে থাকা যাচ্ছে না। কয়লা, লোহা আনুষঙ্গিক জিনিসপত্রের দাম বেড়েছে। পরিশ্রমের পয়সা ওঠানোই  দায়। তার ওপর বাজারের যে অবস্থা, সামান্য আয়ে চারজনের সংসার এখন আর চলে না। দীর্ঘশ্বাস ফেলে তিনি বললেন, ‌‘জীবন এহন আর চলে না। এই পেশায় আর কেউ আইবে না। আমার পোলাপানরে তো আনমুই না। ক্যান যে আমি (কামার পেশা) আইছিলাম।’

বরিশাল নগরের চৌমাথা বাজারে উত্তর-পূর্ব কোণে নবগ্রাম খালের পাড়ে ছাপরায় সৌরভ দাসের দোকান। রাতে এই দোকানেই ঘুমান তিনি। ১৫ অক্টোবর রাতে ওই দোকানে সৌরভের সঙ্গে কথা হয়। তিনি জানান, এখন এক বস্তা কয়লার দাম এক হাজার টাকা। আগে এর দাম ছিল ২০০ থেকে ৩০০ টাকা। লোহার হাতিয়ার (দা, কুড়াল, চাকু, বঁটি, ছুরি) তৈরি করা একজনের পক্ষে সম্ভব নয়; একজন সহযোগী দরকার হয়। লোহালক্কড়ের দামও তিন থেকে চার গুণ বেড়েছে। দিনে বেচাবিক্রি ২০০ টাকাও হয় না। এ পেশায় টিকে থাকা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ছে।

সৌরভ দাসের বাড়ি বরিশালের গৌরনদী উপজেলার নলচিড়া গ্রামে। বসতভিটাই তাঁদের পরিবারের একমাত্র সম্বল। দুই ভাইয়ের মধ্যে সৌরভ ছোট। বড় ভাই গোপাল দাস এলাকায় দরজির কাজ করেন। বাবা বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী। কাজকর্ম করতে পারেন না। ছোটবেলা থেকেই দুই ভাই পরিবারের বোঝা কাঁধে নেন। বড় ভাই  দরজির কাজ শেখেন আর সৌরভ কামারের কাজ। বয়সের ভারে বাবা বিমল দাস এখন শয্যাশায়ী। মা পক্ষাঘাতে অসুস্থ। সৌরভ বিয়ে করেছেন বছর দশেক আগে। সৌরভের স্ত্রী স্বর্ণালী দাস দুই ছেলে–মেয়েকে নিয়ে গ্রামের বাড়ি থাকেন। ছেলে সিপ্ত দাস (৮) চতুর্থ  শ্রেণিতে পড়ে। মেয়ে সকাল দাসের বয়স তিন বছর।

আনাম (আস্ত) লোহা গলানো, পিটায়ে হাতিয়ার বানাতে যে কী পরিশ্রম, তা যে করে হেই বোঝে। গাধার খাটুনি খাইট্টা কোনো দিন ১০০ টাকা, কোনো দিন ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা ইনকাম। এই দিয়া কি সংসার চলে?
সৌরভ দাস, কামার

সৌরভ হাপর টানতে টানতে নিজের দুর্দশার কথা বর্ণনা করেন। বলেন, ‘ব্যবসা-বাণিজ্য এখন ভালো না। একা এই কাম করন যায় না। ঠেইক্কা তা–ও করি। আনাম (আস্ত) লোহা গলানো, পিটায়ে হাতিয়ার বানাতে যে কী পরিশ্রম, তা যে করে হেই বোঝে। গাধার খাটুনি খাইট্টা কোনো দিন ১০০ টাকা, কোনো দিন ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা ইনকাম। এই দিয়া কি সংসার চলে? মাসে ঘরভাড়াসহ সাড়ে তিন হাজারের ওপর খরচ। নিজে তিন বেলা খাই। তারে তো খাওন কয় না, খালি বাঁচনের লইগ্যা খাই। এইতেও তো দেড় থেকে দুই শ যায়। তারপর হাতে থাকে কন?’

কামার পেশার বাইরে আর কোনো কাজ জানেন না সৌরভ। তাই কষ্টেসৃষ্টে এই কাজই করে যাচ্ছেন। সন্তানকে এই পেশায় আনতে চান না তিনি। সৌরভ জানান, এখন আর কোনো কামারই চান না পরবর্তী প্রজন্ম এই পেশায় আসুক। পেশাটি এখন বিলুপ্তপ্রায়।
কামার একটি প্রাচীন পেশা। কামারেরা লোহা দিয়ে বিভিন্ন গৃহস্থালি, কৃষিকাজে বা অন্যান্য কাজে ব্যবহার্য লৌহজাত সামগ্রী তৈরি করেন। প্রাচীনকাল থেকেই হিন্দুসমাজের শূদ্র সম্প্রদায় কামার পেশার সঙ্গে জড়িত ছিল। গ্রামের বাজারে অথবা নির্দিষ্ট এলাকায় এসব পেশাজীবীকে ঘিরে কামারপাড়া গড়ে উঠত।

বরিশাল নগর ও নগরের উপণ্ঠে একসময় অনেক কামারের বসতি ছিল। প্রযুক্তির দাপটে এখন তা কেবলই স্মৃতি। যাঁরা এই পেশায় টিকে আছেন, তাঁরাও ধুঁকছেন আর্থিক সংকটে।

বরিশাল নগর ও নগরের উপণ্ঠে একসময় অনেক কামারের বসতি ছিল। নগরের হাটখোলা, নতুন বাজার, বাংলাবাজার, নথুল্লাবাদ, পলাশপুর, বউবাজার, বেলতলা, চাঁদমারী, তালতলী বাজার, সদর উপজেলার চরকাউয়া, সাহেবের হাট, লাহার হাটসহ ছোট-বড় সব হাটে অনেক কামারের বসতি ছিল। তবে প্রযুক্তির দাপটে এখন তা কেবলই স্মৃতি। যাঁরা এই পেশায় টিকে আছেন, তাঁরাও ধুঁকছেন আর্থিক সংকটে।

সৌরভ দাস জানালেন, বরিশাল শহরে এখন হাটখোলা এলাকায় দু-চার ঘর কামার আছেন। এই প্রজন্ম শেষ হলে এই পেশা বিলুপ্ত হবে। তাঁরা ক্ষুদ্রঋণ সহায়তাও পান না। কারণ, কামারদের ঘরবাড়ি নেই। দুবেলা আধপেট খেয়ে থাকা গরিবদের কেউ দুই পয়সা ঋণও দিতে চায় না।

আলাপ করে ফেরার সময় সৌরভ আক্ষেপ করে হাসলেন। হাপরের চেইনে কয়লার আগুন চাঙা করতে করতে বললেন, ‘কামারগো তো কেউ মানুষ মনে করে না। আমরা এত পরিশ্রম কইরা লোহার হাতিয়ার বানাই; কিনতে আইলে দামাদামির শেষ নাই। এ দেশে যত হিসাব গরিবের লগে। গরিবেরা না খাইয়্যা, না পইরা দুবেলা খাইয়্যা বাঁচনের জন্য পরিশ্রম করবে, এইটাই যেন নিয়ম। কেউ আমাগো কথা ভাবে না। আমাগোও তো একটা জীবন আছে।’