আজ জাদুঘর দিবস
ইতিহাস ও ঐতিহ্যের প্রতিচ্ছবি
খুলনা বিভাগীয় জাদুঘরে অঞ্চলের ইতিহাস ও ঐতিহ্যকে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। এটি মূলত প্রত্নতত্ত্ব জাদুঘর।
যশোরের কেশবপুর উপজেলার ভরত ভায়না গ্রামে ভরত ভায়না বৌদ্ধমন্দির অবস্থিত। ১৯৮৪-৮৫ সাল থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত চারবার প্রত্নতাত্ত্বিক খননকাজ পরিচালনা করে বৌদ্ধমন্দিরটি আবিষ্কার করে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের খুলনা আঞ্চলিক কার্যালয়। সপ্তম শতক থেকে নবম শতকে নির্মিত ওই বৌদ্ধমন্দির খননের সময় বেরিয়ে আসে বাংলাদেশে পাওয়া সবচেয়ে বড় আকারের একক পোড়ামাটির ফলকচিত্রের অংশবিশেষ।
ওই ফলকচিত্র স্থান পেয়েছে খুলনা বিভাগীয় জাদুঘরে। ওই ফলকচিত্রের মতো খুলনা অঞ্চলের ইতিহাস ও ঐতিহ্যকে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে খুলনা বিভাগীয় জাদুঘরে। এটি মূলত একটি প্রত্নতত্ত্ব জাদুঘর। বর্তমানে জাদুঘরে প্রায় এক হাজার নিদর্শন (প্রত্নবস্তু) রয়েছে। দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীদের জন্য রয়েছে ব্রেইল পদ্ধতির কিছু নিদর্শন। খুলনা অঞ্চল ছাড়াও ঢাকা, রাজশাহী, বগুড়া, কুমিল্লা ও নওগাঁ অঞ্চল থেকে প্রাপ্ত বিভিন্ন প্রত্নতত্ত্ব নিদর্শন স্থান পেয়েছে এ জাদুঘরে। তারপরও জাদুঘর পরিদর্শনে দর্শনার্থীর সংখ্যা খুবই কম।
এ বাস্তবতায় আজ শনিবার উদ্যাপন করা হচ্ছে আন্তর্জাতিক জাদুঘর দিবস। দিবসটি উপলক্ষে সকাল ১০টায় শোভাযাত্রা বের হবে জাদুঘর থেকে। নগরের বিভিন্ন সড়ক প্রদক্ষিণ করে তা আবার জাদুঘর চত্বরে এসে শেষ হবে। দিবসটি উপলক্ষে স্কুলের শিক্ষার্থীদের জন্য জাদুঘরটি উন্মুক্ত থাকবে।
নগরের শিববাড়ী মোড়ে খুলনা বিভাগীয় জাদুঘর অবস্থিত। জাদুঘর সূত্র জানায়, এ জাদুঘরে খুলনা বিভাগের ১০ জেলা ও বাংলাদেশের বিভিন্ন উল্লেখযোগ্য প্রত্নস্থান থেকে সংগৃহীত প্রত্ননিদর্শন প্রদর্শিত হচ্ছে। জাদুঘর পরিদর্শনে যেকোনো দর্শনার্থীই খুলনা অঞ্চল এবং বাংলাদেশের ইতিহাস ও ঐতিহ্য সম্পর্কে একটি ভালো ধারণা পাবেন। জাদুঘরটি পরিচালনা করে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর। মঙ্গলবার থেকে শনিবার পর্যন্ত প্রতিদিন সকাল ১০টা থেকে ৬টা পর্যন্ত ও সোমবার বেলা ২টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত জাদুঘরটি দর্শনার্থীদের জন্য খোলা থাকে আর বন্ধ থাকে প্রতি রোববার। প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য পরিদর্শন মূল্য ২০ টাকা। আর পঞ্চম থেকে দশম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের জন্য প্রবেশের মূল্য মাত্র ১০ টাকা। পঞ্চম শ্রেণির আগপর্যন্ত শিশুদের জন্য কোনো প্রবেশ মূল্য নেই।
জাদুঘরসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ১৯৮৬ সালে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর প্রথম খুলনায় একটি জাদুঘর নির্মাণের উদ্দেশ্যে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ে প্রকল্প আকারে প্রস্তাবনা পাঠায়। ১৯৮৭ সালে খুলনা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (কেডিএ) কাছ থেকে জাদুঘর নির্মাণের জন্য এক একর জমি বরাদ্দ পায়। ১৯৯৮ সালে ভবনের নির্মাণকাজ শেষ হওয়ার পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ১২ সেপ্টেম্বর জাদুঘরটির উদ্বোধন করেন। জাদুঘরে বিশেষ কিছু নিদর্শন রয়েছে, যা অন্য কোনো জাদুঘরে নেই। তারপরও জাদুঘর পরিদর্শনে দর্শনার্থীর সংখ্যা খুবই কম।
খুলনা বিভাগীয় জাদুঘরের সহকারী মডেলার কানিজ ফাতেমা প্রথম আলোকে বলেন, এটি প্রত্নতাত্ত্বিক জাদুঘর হওয়ায় দর্শনার্থীদের আনাগোনা কম। সাধারণ দিনে গড়ে ২৫ জনের মতো দর্শনার্থী আসেন জাদুঘরে। আর কোনো দিবস বা বিশেষ দিনে দর্শনার্থী পাওয়া যায় ৪০-৫০ জন। মাঝেমধ্যে জাদুঘরের পক্ষ থেকে শহরের বিভিন্ন স্কুলের শিক্ষার্থীদের জাদুঘর পরিদর্শনের জন্য আমন্ত্রণ করে নিয়ে আসা হয়।
সরেজমিনে দেখা যায়, জাদুঘরটি অষ্টভূজাকৃতির। তাতে ছয়টি প্রদর্শনী গ্যালারি রয়েছে। ১ নম্বর গ্যালারিতে স্থান পেয়েছে খুলনার বিভিন্ন অঞ্চল থেকে সংগৃহীত বিভিন্ন প্রত্নসম্পদ। এর মধ্যে ভরত ভায়না বৌদ্ধমন্দির, পীরপুকুর মসজিদ, গলাকাটা মসজিদ, জোড়বাংলা মসজিদ, সাতগাছিয়া মসজিদ, জাহাজঘাটা, দমদম পীরস্থান ঢিবি, খানজাহান আলীর (র.) বসতভিটায় পাওয়া নিদর্শন। আরও রয়েছে খুলনা আর্ট কলেজ থেকে পাওয়া ১২-১৩ শতকের শক্তি মূর্তি, কপিলমুনি ঢিবি গুচ্ছ থেকে সংগৃহীত পোড়ামাটির সামগ্রী প্রভৃতি।
২ নম্বর গ্যালারিতে প্রদর্শিত হচ্ছে পোড়ামাটি ও শামুকের তৈরি চুড়ি, পোড়ামাটির অলংকৃত ইট, পোড়ামাটির খেলনা, ওজন, পিরিচ, থালাসহ নানা কিছু। ৩ নম্বর গ্যালারিতে স্থান পেয়েছে উত্তরবঙ্গের উল্লেখযোগ্য প্রত্নস্থান মহাস্থানগড় ও মঙ্গলকোট থেকে সংগৃহীত বিভিন্ন প্রত্ননিদর্শন। এর মধ্যে রয়েছে পোড়ামাটির ফলকচিত্র, তামার তৈরি মৃৎপাত্র, স্বল্প মূল্যবান পাথরের পুঁতি, বিভিন্ন ধরনের মৃৎপাত্র, ছাপাঙ্কিত রৌপ্য মুদ্রা ও ছাঁচে–ঢালা মুদ্রা, মসৃণ কালো মৃৎপাত্র এবং পোড়ামাটির ফলকে চিত্রিত মানুষের মাথা।
৪ নম্বর গ্যালারিতে প্রদর্শিত হয়েছে লালমাই ময়নামতি অঞ্চলে অবস্থিত শালবনবিহার, আনন্দবিহার, ভোজবিহার, রানীরবাংলো, ইটাখোলা মুড়া, রূপবান মুড়া, কুটিলা মুড়া ও চারপত্র মুড়া প্রত্নস্থান থেকে সংগৃহীত প্রত্নসম্পদ। পঞ্চম গ্যালারিতে রয়েছে পাহাড়পুর বৌদ্ধবিহারের প্রত্ননিদর্শন। ৬ নম্বর গ্যালারিতে প্রদর্শিত হয়েছে গৌড়, লালবাগ কেল্লা, সাভার ও রোয়াইল বাড়ি থেকে সংগৃহীত প্রত্নবস্তু। ওই গ্যালারিতে আরও আছে খ্রিষ্টীয় ১৭০০-১৯০০ শতকের বিভিন্ন ধরনের প্রচলিত আরবি ও ফারসি হস্তাক্ষর লিপি এবং শত বছরের পুরোনো কাঠের খাট।
গত মঙ্গলবার দুপুরে এক বন্ধুকে নিয়ে জাদুঘরে গিয়েছিলেন খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী মো. আসাদুর রহমান। তিনি বলেন, ‘এই জাদুঘরে প্রথমবারের মতো আসা। এখানে আমাদের ইতিহাস-ঐতিহ্যের অনেক কিছু দেখছি। আমার কাছে মনে হয়েছে একটা বিভাগীয় জাদুঘরের তুলনায় এটা বেশ ছোট, তা ছাড়া কোনো বিষয়কে মানুষের কাছে আকর্ষণীয় করতে প্রচারণা দরকার। কিন্তু এই জাদুঘরের ক্ষেত্রে আমরা তা দেখি না। এ ক্ষেত্রে প্রচার বাড়ালে আমার মনে হয় দর্শনার্থী বাড়তে পারে।’
খুলনা বিভাগীয় প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক মো. গোলাম ফেরদৌস বলেন, এটি একটি সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের জাদুঘর, যা এই অঞ্চলের ইতিহাসকে প্রতিনিধিত্ব করে। সাধারণত যেখানে বড় কোনো প্রত্ন নিদর্শন থাকে, সেখানে এ ধরনের জাদুঘরে দর্শনার্থীর সংখ্যা বেশি থাকে। শহরের মধ্যে হওয়ায় যাঁরা এ ধরনের ঐতিহ্যকে ভালোবাসেন, তাঁরাই জাদুঘর পরিদর্শনে আসেন। জাদুঘরটি অন্য অনেক জাদুঘরের তুলনায় বেশ সমৃদ্ধ। এই জাদুঘরে বস্তু প্রদর্শনের পদ্ধতি সেকেলে। এখন জাদুঘরের ধারণা পরিবর্তন হয়েছে। বিশ্বের অন্যান্য দেশের সঙ্গে তাল মিলিয়ে আধুনিকায়ন করতে পারলে দর্শনার্থী বাড়বে বলে মনে করেন তিনি।