‘এই শীতে বাঘও শিকারে যায় না, কিন্তু আমরা পানিতে নেমে মাছ ধরি’
কুয়াশার আবরণে ঢেকে গেছে পুরো ঘেরের পানি। পৌষের রাতে কনকনে ঠান্ডা উপেক্ষা করে ঘেরের পানিতে নেমে পড়েছেন কয়েকজন। ভোরবেলায় স্থানীয় বাজারে মাছের ভালো দাম পাওয়ার আশায় গভীর রাত থেকেই মাছ ধরার কাজ শুরু করেছেন যশোরের কেশবপুরের এসব মৎস্যজীবী। অনেক সময় মাছ ধরার কাজ শেষ হতে হতে দুপুরও গড়ায়।
কেশবপুর উপজেলার মধ্যকুল গ্রামের দুটি মাছের ঘেরে প্রায় একই রকম দৃশ্য দেখা গেল। উপজেলায় এ পেশার সঙ্গে কয়েক হাজার মানুষ যুক্ত। তাঁদের পেশাটি তুলনামূলক কঠিন ও কষ্টদায়ক হলেও এভাবেই কাজ করে আসছেন। তীব্র শীতে যখন মানুষ ঘরে শুয়ে উষ্ণতায় নিজেকে মুড়ে রাখতে চান, গরম কাপড়ের ওম নেন কিংবা গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন থাকেন, তখনো ঘেরের শীতল পানিতে নেমে মাছ ধরে জীবন-জীবিকা নির্বাহ করেন এসব মানুষ।
উপজেলা মৎস্য অফিস সূত্রে জানা গেছে, কেশবপুরে ৪ হাজার ৬৮৮টি মাছের ঘের আছে। আর মৎস্যজীবী আছেন ২ হাজার ১৯০ জন। শুধু তা–ই নয়, আশপাশের অনেক এলাকার বিপুলসংখ্যক মানুষ যুক্ত আছেন এই পেশার সঙ্গে।
পৌষ-মাঘ মাসে ঘেরগুলোয় পানি সেচ দিয়ে ফসল চাষের উপযোগী করার প্রবণতা দেখা যায়। এ কারণে বছরের এ সময়ে মাছ ধরার ব্যস্ততাও তুলনামূলকভাবে বেড়ে যায়। তখন ঘেরগুলোয় ব্যাপকসংখ্যক মানুষ মাছ ধরার শ্রমিক হিসেবে কাজ করেন। তাঁরা মাছের ঘের ব্যবসায়ীদের পাশাপাশি জাতীয় অর্থনীতিতে শ্রম দিয়ে অবদান রাখলেও উপেক্ষিত বলে অভিযোগ করেছেন। তাঁদের মতে, এ কষ্টকর পেশার যথাযথ মূল্যায়ন কখনো হয় না। সেই সঙ্গে এত কষ্ট করে তাঁদের ভাগ্যের পরিবর্তনও হয় না। বছরের একটি নির্দিষ্ট সময়ে তাঁদের অনেককেই কর্মহীন থাকতে হয়।
গতকাল মঙ্গলবার মধ্যকুল গ্রামের ওই দুই ঘেরে দেখা যায়, তীব্র শীত উপেক্ষা করে মাছ ধরছেন কয়েকজন মৎস্যশ্রমিক। ঘেরের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে বড় জাল টেনে মাছ তুলে আনছেন।
কাজ করতে করতে মৎস্যজীবী ও পরচক্রা গ্রামের বাসিন্দা প্রশান্ত সরকার বলেন, তাঁরা কাজের সন্ধানে সাধারণত গভীর রাতে বাড়ি থেকে বের হন। কনকনে ঠান্ডায় পানিতে নামতে হয়। একেকটি দলে ২০ থেকে ২৫ জন লোক থাকেন। তাঁরা ঘেরে মাছ ধরে ৬ থেকে ৮ হাজার টাকা পান। সেটা নিজেরা ভাগ করে নেন সমান হারে। এতে দেখা যায়, কারও কারও দিনে ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা আয় হয়।
নুরুল ইসলাম নামের আরেক মৎস্যশ্রমিক বলেন, যখন পানিতে নামেন, তখন মনে হয়, পানির নিচে থাকা শরীরে অংশটুকু অবশ হয়ে আছে। কাজটি অত্যন্ত কষ্টকর হলেও সংসার চালাতে এটিকে পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছেন। পরচক্রা গ্রামের আরেক মৎস্যজীবী সমর বৈদ্য বলেন, ‘এই শীতে বাঘও শিকারে যায় না, কিন্তু আমরা পানিতে নেমে মাছ ধরি।’
অঞ্চলটিতে মাছ চাষের পেছনে এসব শ্রমিকশ্রেণির অবদানকে বেশ গুরুত্বের সঙ্গে দেখেন ঘের ব্যবসায়ী আজিজুর রহমান। তিনি বলেন, ‘আমরা মাছ উৎপাদন করি। কিন্তু মাছ ধরার জন্য অবশ্যই এই শ্রমিকদের ওপর আমাদের নির্ভর করতে হয়। তাঁরাই আমাদের অর্থ উপার্জনের মাধ্যম। অনেকটা বলা যায়, তাঁদের কারণেই এই মৎস্য চাষ টিকে আছে। ’
জ্যেষ্ঠ উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা সুদীপ বিশ্বাস বলেন, এসব মৎস্যজীবী নীরবে জাতীয় আয়ে ভূমিকা রাখছেন। কিন্তু তাঁরা অনেকাংশে উপেক্ষিত। এই পেশাজীবীর মানুষের জীবনমান উন্নয়নে সরকারি সাহায্য দরকার। বিকল্প কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করাও দরকার।