‘গুলিতে আমার স্বামী শেষ, পোলাডারে অনে ক্যামনে পালুম?’

নিহত আরিফ হোসেনের স্ত্রী শরিফা বেগম ও তাঁর ছেলেছবি: সংগৃহীত

‘গুলি খাইয়া আমার স্বামী শেষ। সে তো কোনো রাজনীতি করত না। মারামারির ধারেকাছেও ছিল না। কী দোষে তাকে অ্যামনে মারা অইল। তার আয়ের ওপরই সংসার চলত। পোলাডারে অনে ক্যামনে পালুম? কয় দিন ধইরা পোলাডা ক্যাল আব্বা–আব্বা করতাছে। তারে ক্যামনে বুঝামু, তার বাপ নাই।’

কান্নাজড়িত কণ্ঠে এভাবেই কথাগুলো বললেন শরিফা বেগম (২২)। কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে সংঘাতে তাঁর স্বামী আরিফ হোসেন ওরফে রাজীব (২৬) ঢাকায় নিহত হয়েছেন। তাঁদের বাড়ি চাঁদপুরের মতলব উত্তর উপজেলার গজরা ইউনিয়নের টরকী এওয়াজ গ্রামে। আরিফ ওই গ্রামের রজ্জব আলী প্রধানের ছেলে। দুই ভাইয়ের মধ্যে আরিফ বড়। তাঁর ছোট ভাই এলাকায় রিকশা চালান। তাঁর চার বোনের মধ্যে তিনজনের বিয়ে হয়েছে। গ্রামের বাড়িতে বাবা, মা ও বোন থাকেন। তাঁদের ছোট্ট একটি টিনের বসতঘর ছাড়া আর কোনো জমিজমা নেই।

পরিবার সূত্রে জানা যায়, গত ২০ জুলাই গাজীপুরে কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে সংঘর্ষের সময় বুকে গুলিবিদ্ধ হন আরিফ। স্থানীয় লোকজন তাঁকে গাজীপুর জেনারেল হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাঁকে মৃত ঘোষণা করেন। আরিফ গাজীপুরের বোর্ড বাজার এলাকায় ভাঙারি দোকানে শ্রমিকের কাজ করতেন। তাঁর তিন বছরের একটি ছেলে রয়েছে।

আজ বৃহস্পতিবার সকালে মুঠোফোনে শরিফা বেগমের সঙ্গে কথা হয়। তিনি বলেন, বোর্ড বাজার এলাকায় ভাড়া বাসায় তাঁরা থাকতেন। স্বামীর আয়ে কোনো রকমে সংসার চলত। গ্রামের বাড়িতেও টাকা পাঠাতে হতো। সেখানে বসতঘর ছাড়া তেমন জায়গাজমি নেই। স্বামীর ওপর সবাই নির্ভরশীল ছিলেন।

আরও পড়ুন
গত ২০ জুলাই গাজীপুরে কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে সংঘর্ষের সময় বুকে গুলিবিদ্ধ হন আরিফ হোসেন। স্থানীয় লোকজন তাঁকে গাজীপুর জেনারেল হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাঁকে মৃত ঘোষণা করেন। আরিফ গাজীপুরের বোর্ড বাজার এলাকায় ভাঙারি দোকানে শ্রমিকের কাজ করতেন।

শরিফা বেগম জানান, ২০ জুলাই বেলা তিনটায় ভাঙারি দোকানে যাওয়ার জন্য বাসা থেকে বের হন আরিফ। তখন ওই এলাকায় পুলিশ ও আন্দোলনকারীদের মধ্যে সংঘর্ষ চলছিল। এর মধ্যে তাঁর স্বামী দোকানের দিকে রওনা হন। নিষেধ করলেও তিনি শোনেননি। ছেলেটি তাঁকে চকলেট আনতে বলেছিল। বাসা থেকে বের হওয়ার কিছুক্ষণ পর মুঠোফোনে একজন জানান, আরিফ গুলিবিদ্ধ হয়েছেন, গাজীপুর জেনারেল হাসপাতালে আছেন। পরে ওই হাসপাতালে গিয়ে জানতে পারেন, তাঁর স্বামী মারা গেছেন। সেখান থেকে তাঁর লাশ গ্রামের বাড়িতে নিয়ে আসেন। ২১ জুলাই মতলব উত্তরের রাঢ়ীকান্দি কবরস্থানে তাঁর লাশ দাফন করা হয়। কয়েক দিন পর ছেলেকে নিয়ে তিনি গাজীপুরের বাসায় চলে আসেন।

আরও পড়ুন
আরিফ মারা যাওয়ার পর পরিবারটি এখন আরও অসহায় হয়ে পড়েছে। পরিবারটি কীভাবে চলবে, তা অনিশ্চিত।
শহিদ উল্লাহ প্রধান, স্থানীয় ইউপি সদস্য

স্বামীকে হারানোর শোকের পাশাপাশি তিন বছরের ছেলেকে কীভাবে বড় করবেন, তা নিয়ে চিন্তায় রয়েছেন শরিফা বেগম। ‘স্বামী হত্যার বিচার কার কাছে চামু? বিচার চাইয়া কী অইব? পোলাডারে লইয়া অনে ক্যামনে বাঁচুম? চোখে–মুখে অন্ধকার দেখতাছি। বাবার জন্য পোলাডা কান্না করতাছে। ভাত-পানিও মুখে দিতাছে না। শুধু বলে, “চকলেট নিয়া বাবা বাসায় আইলেই ভাত খামু।” পোলাকে নিয়ে খুব কষ্টে আছি।’ বেদনাভরা গলায় একনাগাড়ে বলে যান শরিফা বেগম।

গজরা ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) সদস্য ও নিহত আরিফ হোসেনের প্রতিবেশী শহিদ উল্লাহ প্রধান বলেন, আরিফ মারা যাওয়ার পর পরিবারটি এখন আরও অসহায় হয়ে পড়েছে। পরিবারটি কীভাবে চলবে, তা অনিশ্চিত। আরিফের পরিবারের পাশে দাঁড়ানোর জন্য সমাজের বিত্তবান মানুষ ও সরকারের কাছে অনুরোধ জানান তিনি।