সেবা-শুশ্রূষা শেষে বনে ফিরেছে ১৫ লজ্জাবতী বানর
লোকালয়ে এসে সাধারণ মানুষের হাতে ধরা পড়ছে। বিদ্যুতের তারে স্পৃষ্ট হয়ে আহত হচ্ছে। এ রকম লজ্জাবতী বানরগুলোকে উদ্ধার করে নিয়ে আসা হচ্ছে মৌলভীবাজারের লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানের জানকীছড়া বন্য প্রাণী রেসকিউ সেন্টারে। স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা প্লামপ্লরিস ইভি এদের চিকিৎসা ও সেবা-শুশ্রূষা দিচ্ছে। এ কার্যক্রমে সহযোগিতা করছে বন বিভাগের বন্য প্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগ। গত এক বছরে এ রকম উদ্ধার হওয়া ২৩টি লজ্জাবতী বানরের মধ্যে ১৫টিকে সেবা-শুশ্রূষা দিয়ে লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানে অবমুক্ত করা হয়েছে।
বন্য প্রাণী গবেষক, বন্য প্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগ এবং প্লামপ্লরিস ইভি সূত্রে জানা গেছে, মৌলভীবাজার জেলাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে লজ্জাবতী বানর ধরা পড়ছে। এরা নিশাচর প্রাণী। রাতে চলাফেরা করার সময় প্রায়ই বিদ্যুতের খোলা তারে স্পৃষ্ট হয়ে আহত হচ্ছে। স্থানীয় লোকজনের মাধ্যমে খবর পেয়ে বন্য প্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগসহ বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন, প্রাণিপ্রেমী ও পরিবেশকর্মীদের মাধ্যমে ধরা পড়া এবং আহত এ প্রাণীদের উদ্ধার করা হচ্ছে।
২০২২ সাল থেকে লজ্জাবতী বানর সংরক্ষণে কাজ করছে জার্মানভিত্তিক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা প্লামপ্লরিস ইভি। সেই থেকে এ পর্যন্ত বিভিন্ন স্থান থেকে ২৩টি লজ্জাবতী বানর উদ্ধার করে জানকীছড়া বন্য প্রাণী রেসকিউ সেন্টারে নিয়ে আসা হয়েছে। সংস্থার লোকজন এই প্রাণীদের দেখাশোনা, চিকিৎসা, সেবা-শুশ্রূষা ও খাবারদাবারের বিষয়টি সার্বক্ষণিক পর্যবেক্ষণ করছেন। এই ২৩টির মধ্যে ১৫টি লজ্জাবতী বানরকে এরই মধ্যে মৌলভীবাজারের লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানে অবমুক্ত করা হয়েছে। বন্য প্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের সহযোগিতায় প্লামপ্লরিস ইভি প্রথমটি অবমুক্ত করেছে ২০২২ সালের ১০ মার্চ। সর্বশেষ অবমুক্ত করা হয়েছে ১৭ জুন।
১৫টি লজ্জাবতী বানরের আচার-আচরণ, চলাফেরাসহ জীবনযাপনের পদ্ধতি সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করতে ৪টিকে পরানো হয়েছে রেডিও কলার। প্রথম রেডিও কলার পরানো হিমু নামের লজ্জাবতী বানরকে অবমুক্ত করা হয় ২০২২ সালের ২০ অক্টোবর। রেডিও কলার পরা শেষটিকে অবমুক্ত করা হয়েছে ১৭ জুন। এ ছাড়া ২৩টির মধ্যে দুটি মারা গেছে। এখন জানকীছড়া বন্য প্রাণী রেসকিউ সেন্টারে আছে ৬টি।
এই ৬টির মধ্যে লুলা নামের ১টি বানরকে ২০২২ সালের ১৮ জুলাই শ্রীমঙ্গলের জেরিন চা-বাগান থেকে বিদ্যুৎস্পৃষ্টে আহত অবস্থায় উদ্ধার করা হয়েছিল। লুলার পা ভেঙে গিয়েছিল। এখন সুস্থ হয়ে উঠেছে। অন্য পাঁচটার মধ্যে শ্রীমঙ্গলের ফুলছড়া চা-বাগান থেকে দুটি, হবিগঞ্জ থেকে একটি ও শ্রীমঙ্গল থেকে দুটি উদ্ধার করা হয়েছে। এগুলোকে এক থেকে দেড় মাসের মধ্যে উদ্ধার করা হয়েছে। সর্বশেষ রোববার শ্রীমঙ্গল থেকে উদ্ধার করা হয়েছে একটিকে। এর মধ্যে ফুলছড়া থেকে উদ্ধার হওয়া একটি বিদ্যুৎস্পৃষ্টে আহত ছিল। এখন কিছুটা সুস্থ হয়ে উঠেছে। এটির এক্স-রে প্রতিবেদনও ভালো এসেছে।
প্লামপ্লরিস ইভির উপব্যবস্থাপক আজিজুল হাকিম আবির আজ সোমবার প্রথম আলোকে বলেন, ‘এখন অনেক লজ্জাবতী বানর ধরা পড়ছে। আগে আহতগুলো মারা যেত। যেখানে-সেখানে ছাড়া হলে টিকতে পারত না। এখন ধরা পড়লে লোকজন জানান। উদ্ধার শেষে রেসকিউ সেন্টারে রেখে চিকিৎসা করি। ভালো খাবারদাবার দিই। সেবা-শুশ্রূষা করি। তারপর অবমুক্ত করা হয়। এই কার্যক্রমে সংকটাপন্ন লজ্জাবতী বানরগুলো সংরক্ষণ করা যাচ্ছে।’
হাকিম আবির জানান, লাউয়াছড়ায় রেডিও কলার পরানো চারটি লজ্জাবতীর ডেটা সংগ্রহ করা হচ্ছে। দুয়েক বছর পর তাদের আচরণ, চলাফেরার ধরন বোঝা যাবে। এ কার্যক্রমে বন বিভাগ সহযোগিতা করছে।
প্লামপ্লরিস ইভি সূত্র জানিয়েছে, লজ্জাবতী বানরকে জার্মানি থেকে আনা আঠা, ঘাসফড়িং, চাষ করা একধরনের পোকা, গাজর ও শসা খাওয়ানো হয়ে থাকে। নারী লজ্জাবতী বানরের ওজন ন্যূনতম ৮০০ গ্রাম ও পুরুষের ওজন ৯০০ গ্রাম হলেই অবমুক্ত করা হয়। দুটি বানর অবমুক্ত করার অপেক্ষায় আছে। এদের একটির ওজন ১ হাজার ১৫৫ গ্রাম ও আরেকটির ৮৫০ গ্রাম। আরও একটু ওজন বাড়লেই এগুলোকে অবমুক্ত করা হবে। তবে এখন সব কটিকে লাউয়াছড়াতে অবমুক্ত করা হবে না।
অপরিচিত নতুন স্থানে অবমুক্ত করা হলে পুরোনোদের সঙ্গে মারামারির ঘটনা ঘটে। এ জন্য যে এলাকা থেকে যেটাকে উদ্ধার করা হয়েছে, সেটাকে সেই এলাকার কাছের বনে অবমুক্ত করা হবে।
বন্য প্রাণী গবেষকদের সূত্রে জানা গেছে, আন্তর্জাতিক প্রকৃতি ও প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষণ সংঘ (আইইউসিএন) লজ্জাবতী বানরকে সংকটাপন্ন প্রাণী হিসেবে লাল তালিকাভুক্ত করেছে। লজ্জাবতী বানর লাজুক বানর নামেও পরিচিত। এটি দেশের ক্ষুদ্রতম বানর-জাতীয় প্রাণী। ইংরেজিতে এটিকে বেঙ্গল স্লো লরিস বা নর্থান স্লো লরিস বলে। বৈজ্ঞানিক নাম Nycticebus bengalensis। নিশাচর এই প্রাণী বাংলাদেশে চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগের চিরসবুজ বনের বাসিন্দা।
লজ্জাবতী বানর বনের গভীরে উঁচু গাছে থাকতে পছন্দ করে। দিনে গাছের খোঁড়লে বা ঘন পাতার আড়ালে ঘুমিয়ে কাটায়। ঘুমালে শরীরকে গোল বলের মতো করে রাখে। বিরল, নিশাচর ও লাজুক হওয়ায় দিনে এদের সহজে চোখে পড়ে না। এগুলো গাছে গাছেই থাকে। সহজে মাটিতে নামে না। ধীরগতিতে চলাফেরা করে। এরা সাধারণত ফল, পাতা, উদ্ভিদের কষ বা নির্যাস ইত্যাদি খায়। মাঝেমধ্যে বড় কীটপতঙ্গ, পাখির ডিম-ছানা, সরীসৃপও খেয়ে থাকে।
বন্য প্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগ সিলেটের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা জাহাঙ্গীর আলম প্রথম আলোকে বলেন, ‘বিভিন্ন স্থানে লজ্জাবতী বানর ধরা পড়ে। আমরাও নিয়ে আসি। প্লামপ্লরিস ইভি লজ্জাবতী বানর নিয়ে রিসার্চ করছে। প্রাণীদের আচার-আচরণ দেখছে। আমরাও এই প্রাণী সম্পর্কে তেমন জানি না। তাদের সেবা-শুশ্রূষায় প্রাণীগুলো ভালো থাকে।’