সন্তানের খোঁজে চার বছর ধরে দ্বারে দ্বারে ঘুরছেন মা
গভীর রাতেই প্রসব বেদনা শুরু হয় তসলিমার। ভোর হতেই অঝোর ধারায় বৃষ্টি। বৃষ্টি মাড়িয়ে তসলিমাকে নেওয়া হয় চুয়াডাঙ্গার একটি বেসরকারি ক্লিনিকে। সেখানে অস্ত্রোপচারের পর জন্ম নেয় ফুটফুটে একটি কন্যাসন্তান। কিন্তু হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ তসলিমাকে জানায়, তাঁর সন্তানটি মৃত ছিল। এরপর টানা দুই দিন জ্ঞান ফেরেনি তাঁর।
জ্ঞান ফেরার পর তসলিমা জানতে পারেন, ক্লিনিকমালিক ও স্বজনেরা মিলে তাঁর সন্তানটি এক দম্পতির কাছে বিক্রি করে দিয়েছেন। সেই সন্তানকে একনজর দেখতে এখন দ্বারে দ্বারে ঘুরছেন তসলিমা।
ঘটনাটি ২০১৮ সালের জুলাই মাসের ২২ তারিখের। এ ঘটনায় ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বরে মেহেরপুর জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে চুয়াডাঙ্গা ইউনাইটেড ক্লিনিকের বিরুদ্ধে মামলা করেন তসলিমা। আদালত পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনকে (পিবিআই) মামলার তদন্তের নির্দেশ দিলে তারা তদন্ত করে আদালতে প্রতিবেদন দাখিল করেন। প্রতিবেদনে চুয়াডাঙ্গা সদর ফাঁড়ির পুলিশ সদস্য সুজন ইসলাম এবং তাঁর আত্মীয় সরোয়ার হোসেন ওরফে পলাশ ও হীরা খাতুন সন্তানটি দত্তকপত্রের মাধ্যমে গ্রহণ করেছেন বলে উল্লেখ করা হয়। আইনি জটিলতায় দীর্ঘ চার বছর নিজের সন্তানকে একনজর দেখতে পারেননি তসলিমা।
তসলিমা প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার পেট থেকে জন্ম নেওয়া সন্তানের চেহারা দেখার জন্য আমি চার বছর ধরে চেষ্টা করছি। আইনি জটিলতায় এখনো সম্ভব হয়নি। এ দেশে ন্যায়বিচার পেতে অনেক সময় লাগে। নিজের সন্তানকেও পেতে আদালতের বারান্দায় ঘুরতে হয়। আমার ফুফাতো ভাই সদর উপজেলার দরবেশপুর গ্রামের বাসিন্দা ও ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) সদস্য সালাম হোসেন মিলে পরিবারকে জব্দ করে আমার সন্তানটি বিক্রি করে দেন।’
অভিযোগের বিষয়ে ইউপি সদস্য সালাম হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘তসলিমার সঙ্গে জমি নিয়ে বিরোধ থাকায় হিংসার বশবর্তী হয়ে মামলায় আমার নাম যুক্ত করেছেন। তাঁর সন্তান জন্মের সময় আমি তো ক্লিনিকেই ছিলাম না।’
মেহেরপুর প্রেসক্লাবে যখন তসলিমার সঙ্গে কথা হয়, তখন সঙ্গে ছিলেন তাঁর মা বাহারুর নেছা। তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘একজন পুলিশ দম্পতি আমাদের সন্তানকে ভুয়া কাগজপত্র দিয়ে কিনে নিয়েছে। শুধু পুলিশ সদস্য বলেই মামলা করেও সন্তান ফেরত পাওয়া যাচ্ছে না। আমার মেয়ে তসলিমার চোখের পানি শুকিয়ে গেছে। সে আর এখন কাঁদতে পারে না। বাচ্চাটি ফেরত পেতে সব রকমের চেষ্টা করেও কিছুই হচ্ছে না।’
চুয়াডাঙ্গা ইউনাইটেডে ক্লিনিকের মালিক রফিকুল ইসলাম বলেন, তসলিমার সন্তানটি তাঁর পরিবারের সদস্যরা দত্তক দিয়ে থাকতে পারেন। এখানে হয়রানি করার জন্য ক্লিনিকের নামে মামলা করা হয়েছে।
আদালত সূত্রে জানা গেছে, আদালতে পিবিআইএর দাখিল করা প্রতিবেদনের ওপর নারাজি আবেদন করেন তসলিমা। এরপর ২০১৯ সালে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগকে (সিআইডি) তদন্তের দায়িত্ব দেন আদালত। বর্তমানে সিআইডি মামলার চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিলের জন্য তদন্ত চালিয়ে যাচ্ছে।
মেহেরপুর সিআইডির ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) ছাইয়েদুর রহমান বলেন, তসলিমার সন্তানটি দলিল করে দত্তক দেওয়া হয়েছে। সেগুলো সঠিক না কি বেঠিক, তা জানতে স্বাক্ষর এক্সপার্টের কাছে পাঠানো হয়েছে। প্রতিবেদন এলে আদালতে জমা দেওয়া হবে।