নির্মাণকাজ নিয়ে অনিশ্চয়তা 

শয্যা না পেয়ে বেশির ভাগ রোগী রয়েছেন বারান্দা ও মেঝেতে। কক্ষসংকটে প্যাথলজি বিভাগ বন্ধ।

খুলনার কয়রা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের নতুন ভবনের নির্মাণকাজ দীর্ঘদিন ধরে বন্ধ রয়েছেছবি: প্রথম আলো

কয়রা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের ৩১ শয্যাবিশিষ্ট তিনতলা ভবন নির্মাণের জন্য ২০২২ সালের ১৬ আগস্ট কার্যাদেশ দেওয়া হয়। প্রায় ১০ কোটি টাকার কাজের মেয়াদ ছিল ৯ মাস। দুই বছরে ভবন নির্মাণকাজের স্থানে গর্ত খুঁড়ে কয়েকটি পিলার স্থাপন করা হয়েছে মাত্র। অথচ ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ১ কোটি ৭৪ লাখ টাকা তুলে নিয়ে পালিয়ে গেছে।

কাজটি পায় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মেসার্স জিয়াউল ট্রেডার্স। জিয়াউল ট্রেডার্সের মালিক জিয়াউল আহসান বলেন, ‘দরপত্র আমার লাইসেন্সে হলেও কাজটি করছিলেন খুলনা-৬ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য আকতারুজ্জামান। তিনি নানা অজুহাতে কাজে কালক্ষেপণ করায় সব দায় এখন আমাদের কাঁধে চেপেছে।’

গত শুক্রবার সরেজমিনে দেখা গেছে, স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের মূল ভবন ভেঙে সেখানে কয়েকটি গর্ত খুঁড়ে পিলার নির্মাণের জন্য রড রাখা হয়েছে। দীর্ঘদিন এভাবে ফেলে রাখায় রডে মরিচা ধরতে শুরু করেছে। তা ছাড়া সেখানে আর কোনো নির্মাণসামগ্রী দেখা যায়নি। এদিকে মূল ভবন ভেঙে ফেলায় রোগীদের ভোগান্তির শেষ নেই। ১৯ শয্যার অপর ভবনটিতে পুরুষ ও নারী রোগীদের একই ওয়ার্ডে পাশাপাশি রাখা হয়েছে। শয্যা না পেয়ে বেশির ভাগ রোগী ও তাঁদের স্বজনেরা রয়েছেন বারান্দা ও মেঝেতে। কক্ষসংকটের কারণে হাসপাতালের প্যাথলজি বিভাগও বন্ধ রয়েছে। 

হাসপাতালের বহির্বিভাগে চিকিৎসা নিতে আসা কয়রার মহারাজপুর এলাকার আবদুস সামাদ বলেন, চিকিৎসক কয়েকটি পরীক্ষার কথা বলেছেন। হাসপাতালে কক্ষসংকটের কারণে যন্ত্র চালু না থাকায় বাইরে থেকে রোগীদের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করাতে হচ্ছে। 

হাসপাতালে ভর্তি রোগীর স্বজন আবুল কালাম আজাদ জানান, তাঁর বৃদ্ধ মাকে ভর্তি করার পর দোতলার সিঁড়ির নিচে থাকতে হয়েছে। পরে বারান্দায় একটি শয্যা পেয়েছেন। 

বছর দুয়েক আগে স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের মূল ভবন ভেঙে নতুন ভবন নির্মাণকাজ শুরু হয় বলে জানান স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের অফিস সহকারী আবদুল হাকিম। তিনি বলেন, শুরুতে ঠিকাদার কাজের ব্যাপারে যথেষ্ট উদাসীনতা দেখিয়েছেন। কার্যাদেশ পাওয়ার কয়েক মাস পর সেখানে কিছু নির্মাণসামগ্রী নিয়ে আসেন। পরে কয়েকটি পিলার তুলে চলে গেছেন তাঁরা। এখন শুনছেন, ঠিকাদার দেশ ছেড়ে পালিয়ে গেছেন। 

উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা মো. রেজাউল করিম বলেন, হাসপাতালের ৩১ শয্যার ভবনটি ভেঙে ফেলার পর থেকে শয্যাসংকট চলছে। এতে বহির্বিভাগেও চিকিৎসাসেবা বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। আগের দরপত্র বাতিল করে নতুন করে ঠিকাদার নিয়োগের দাবি জানিয়েছেন তিনি। 

খুলনা স্বাস্থ্য প্রকৌশল দপ্তর সূত্রে জানা যায়, ১৯৬৪ সালে কয়রা উপজেলার জায়গীরমহল গ্রামে স্থাপিত হয় ৩১ শয্যাবিশিষ্ট উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স। সেখানে ২০১১ সালে তা ৫০ শয্যায় উন্নীত করা হয়। পরে ৩১ শয্যাবিশিষ্ট পুরোনো ভবন ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করে ২০২২ সালে অপসারণ করা হয়। একই বছরের ১৬ আগস্ট ৩১ শয্যার তিনতলা ভবন নির্মাণে কার্যাদেশ দেওয়া হয়। কাজের মেয়াদ ছিল ২০২৩ সালের ১২ জুন পর্যন্ত। ছয়তলা ফাউন্ডেশনের তিনতলা ভবন নির্মাণকাজের ব্যয় ধরা হয় ৯ কোটি ৭৬ লাখ টাকা। মেয়াদ শেষ হলেও কাজ হয়েছে মাত্র ১১ শতাংশ। কাজের অগ্রগতি না হওয়ায় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে চিঠি দেয় খুলনা স্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর। একপর্যায়ে ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত কাজের মেয়াদ বাড়ানো হয়। দুই দফা মেয়াদ শেষে কাজের অগ্রগতি সন্তোষজনক না হওয়ায় কার্যাদেশ বাতিলের সুপারিশ করেছেন নির্বাহী প্রকৌশলী। 

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক খুলনা স্বাস্থ্য প্রকৌশল দপ্তরের এক কর্মকর্তার বলেন, সাবেক সংসদ সদস্য আক্তারুজ্জামান কাজটির দায়িত্বে থাকায় তদারকি বাধাগ্রস্ত হয়েছে। তিনি ক্ষমতার অপব্যবহার করে বরাদ্দ তুলে নিয়েছেন। এ প্রকল্পের কার্যাদেশ বাতিল হলে অবশ্যই ক্ষতি অনুযায়ী জরিমানা দিতে হবে। 

স্থানীয় ব্যক্তিরা বলেন, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের দলীয় মনোনয়ন পাননি আক্তারুজ্জামান। গত ৫ আগস্ট ছাত্র–জনতার আন্দোলনের মুখে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর আত্মগোপনে চলে যান এ সাবেক সংসদ সদস্য। তাঁর ব্যবহৃত মোবাইল নম্বরও বন্ধ রয়েছে। এ পরিস্থিতিতে কয়রা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ভবন নির্মাণকাজ শেষ হওয়া নিয়ে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে। 

খুলনা স্বাস্থ্য প্রকৌশল দপ্তরের নির্বাহী প্রকৌশলী শাহরিয়ার হাসান মহিউদ্দিন। তিনি বলেন, তাঁরা মূল ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছিলেন। বিষয়টি স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে জানানো হয়েছে। সেখান থেকে প্রকল্পটি বাতিল বা নবায়ন যাহোক, একটি করা হবে। বাতিল হলে প্রকল্পটির জন্য আবার দরপত্র আহ্বান করা হবে।