ফরিদপুর বঙ্গবন্ধু শেখ মেডিকেল হাসপাতালে কেন বারবার আগুন লাগছে

আগুন নেভার পর স্টোররুমে অক্ষত জিনিস খুঁজছেন কর্মীরা। ফরিদপুরের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে বৃহস্পতিবারছবি: প্রথম আলো

ফরিদপুরের বঙ্গবন্ধু শেখ মেডিকেল হাসপাতালে গত দুই মাসের মধ্যে তিনবার অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে গতকাল বৃহস্পতিবারের অগ্নিকাণ্ডের ঘটনাটি ছিল তুলনামূলকভাবে বড়। বারবার আগুন লাগার পর একটি তদন্ত কমিটি গঠন করছে কর্তৃপক্ষ।

ফরিদপুর শহরের পশ্চিম খাবাসপুর মহল্লায় ঢাকা-বরিশাল মহাসড়কের পূর্ব পাশে ১৯৯১ সালে ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ স্থাপিত হয়। প্রথমে ২৫০ শয্যার হাসপাতাল হিসেবে চালু হলেও বর্তমানে এ হাসপাতালের শয্যাসংখ্যা ৫০০। দুই বছর আগে এটির নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় ফরিদপুর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল।

হাসপাতালটিতে ফরিদপুরের বিভিন্ন উপজেলা ছাড়াও, আশপাশের জেলা মাদারীপুর, গোপালগঞ্জ, শরীয়তপুর, নড়াইল, মাগুরা, ঝিনাইদহ, কুষ্টিয়া ও রাজবাড়ীর রোগীরা নিয়মিত চিকিৎসা নিতে আসেন।

হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, ৫০০ শয্যার হাসপাতাল হলেও প্রতিদিন গড়ে এক হাজারের বেশি রোগী ভর্তি থাকেন। দুটি বহির্বিভাগে প্রতিদিন গড়ে দুই হাজারের বেশি রোগী চিকিৎসা নেন।

গতকাল সকাল পৌনে ৯টার দিকে হাসপাতালটির নতুন ভবনের দ্বিতীয় তলার পশ্চিম পাশে অবস্থিত ভান্ডারকক্ষে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। কক্ষটি গ্রিল ও থাই গ্লাস দিয়ে সুরক্ষিত। অগ্নিকাণ্ডের সময় ৩ হাজার ৬০০ বর্গফুটের ওই কক্ষটি বাইরে থেকে তালাবদ্ধ ছিল। আগুনে ওই কক্ষে থাকা যন্ত্রপাতি, ওষুধ ও প্রয়োজনীয় কাগজপত্র পুড়ে যায়। পরে ফরিদপুর ফায়ার সার্ভিসের সদস্যরা গিয়ে আগুন নেভান।

আগুন লাগার ঘটনায় হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ও চিকিৎসা নিতে আসা রোগী ও তাঁদের স্বজনদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। অনেক রোগী আতঙ্কের কারণে দ্রুত হাসপাতাল থেকে নিচে নেমে আসেন। ওই সময় বিদ্যুৎ ও হাসপাতালের জেনারেটর বন্ধ থাকায় নয়তলাবিশিষ্ট হাসপাতাল ভবন থেকে সিঁড়ি বেয়ে রোগীদের নিচে নামতে হুলুস্থুল বেঁধে যায়।

গত ৫৪ দিনে এ হাসপাতালে অগ্নিকাণ্ডের মোট তিনটি ঘটনা ঘটেছে। প্রথম ঘটনা ঘটে গত ২২ মার্চ। ওই দিন হাসপাতালের মর্গে আগুন লাগে। মর্গে মৃতদেহ ছিল এবং মর্গটির মূল ফটক বাইরে থেকে বন্ধ ছিল। কক্ষটিতে কোনো বৈদ্যুতিক সংযোগ ছিল না। এর ৯ দিন পর দ্বিতীয় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে হাসপাতালের ৯ তলা (নতুন ভবন) ভবনের ষষ্ঠ তলায়। এ দুটি অগ্নিকাণ্ডে ফায়ার সার্ভিসকে ডাকা হয়।

প্রতিটি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে নয়তলাবিশিষ্ট হাসপাতালের নতুন ভবনে। এ ভবনের অদূরে অবস্থিত চারতলাবিশিষ্ট পুরোনো ভবনে এখন পর্যন্ত অগ্নিকাণ্ডের কোনো ঘটনা ঘটেনি।

আগুন ধরার পর মহাবিপদে পড়েন রোগীরা

গতকালের অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় রোগীদের পড়তে হয় মহাবিপদে। হাসপাতালের নবম তলার শিশু ওয়ার্ডে চার দিন বয়সী শিশুকে নিয়ে অবস্থান করছিলেন শহরের সিঅ্যান্ডবি ঘাট এলাকার বাসিন্দা ফরিদ বেপারির স্ত্রী মিতু (৩০)। তিনি বলেন, ‘আমার চার দিনের শিশুকে ইনকিউবেটরে রাখা হয়েছিল। নার্সরা যখন আগুনের কথা বলে আমাদের দ্রুত নেমে যেতে বলেন, তখন আমি কাচঘরে থাকা শিশুকে নিয়ে দ্রুত সিঁড়ি দিয়ে নেমে যাই। ১৩ মিনিট বাইরে থাকায় আমার সন্তানের গায়ের রং কালো হয়ে যায়। পরে নার্সদের সহায়তায় ওকে আবার ওপরে নিয়ে আসি।’

পাঁচতলায় পুরুষ সার্জিক্যাল ওয়ার্ডে ভর্তি প্রতিবন্ধী জাহাঙ্গীর ফকিরের সঙ্গে ছিলেন তাঁর স্ত্রী সেলিনা বেগম (৪০)। সেলিনা বলেন, ‘আগুন লাগার পর হাসপাতাল ত্যাগ করার নির্দেশ দেওয়ার পর আমি স্বামীকে কীভাবে পাঁজাকোলা করে সিঁড়ি দিয়ে নিচে নেমেছি, সে কষ্টের কথা ভাষায় প্রকাশ করতে পারব না। একটা লোকও আমাদের সাহায্যে আগায় আসে নাই।’

হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ যা বলছে

ফরিদপুর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সহকারী পরিচালক দীপক কুমার বিশ্বাস বলেন, যে ভান্ডারকক্ষে আগুন লেগেছে, সেখানে মূলত পুরোনো যন্ত্রপাতি রাখা হতো। কক্ষটি সুরক্ষিত। গ্রিল, থাই গ্লাস ও চারটি তালা দিয়ে বন্ধ থাকে। এটি অন্তর্ঘাত হতে পারে না, কেননা এত নিরাপত্তা ভেদ করে কারও পক্ষে ওই কক্ষে আগুন দেওয়া সম্ভব নয়।

বারবার এ হাসপাতালে কেন অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটছে, তা খতিয়ে দেখতে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে সাত সদস্যবিশিষ্ট একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। গতকাল গঠিত এ কমিটিকে আগামী সাত কর্মদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে।

তদন্ত কমিটির প্রধান করা হয়েছে অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট (এডিএম) মোহাম্মদ আলী সিদ্দিকীকে। সাত সদস্যবিশিষ্ট কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন পুলিশ সুপারের প্রতিনিধি, ফরিদপুর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালকের প্রতিনিধি, গণপূর্ত বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী, স্বাস্থ্য ও প্রকৌশল বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী, ওজোপাডিকোর নির্বাহী প্রকৌশলী ও ফরিদপুর দমকল বাহিনীর সহকারী পরিচালক।

কমিটির প্রধান এডিএম মোহাম্মদ আলী সিদ্দিকী বলেন, আগামী রোববার থেকে এ কমিটি কাজ শুরু করবে। তবে আগামী মঙ্গলবার ফরিদপুরের দুটি উপজেলা পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। নির্বাচনসংক্রান্ত কাজের ব্যস্ততার জন্য এক সপ্তাহের মধ্যে প্রতিবেদন দেওয়া কষ্টসাধ্য হবে। তবে দ্রুত তদন্তকাজ শেষ করার উদ্যোগ নেওয়া হবে।

ফরিদপুর বিএমএ ও স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের সভাপতি আ স ম জাহাঙ্গীর চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি এ অগ্নিকাণ্ডের বিষয়গুলো লোকমুখে শুনেছি। বিএমএর সভাপতি হিসেবে হাসপাতালের পরিচালক এ ব্যাপারে আমাকে অবগত করেননি। তবে এ ক্ষেত্রে নাশকতার বিষয় উড়িয়ে দেওয়া যায় না। হাসপাতালে এ ধরনের অগ্নিকাণ্ড কোনোভাবে মেনে নেওয়া যায় না। ভবিষ্যতে যাতে এ–জাতীয় ঘটনার পুনরাবৃত্তি না ঘটে, এ জন্য আমি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে জরুরিভিত্তিতে কথা বলে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেব।’

আরও পড়ুন