‘হে আল্লাহ, তোমার এইডা কুন গজব পড়ল যে আমার মাইয়া ও মাইয়ার জামাই, চারইডা নাতি–নাতনি আগুনে পুইড়া মরতে অইল? অহন ভিডায় বাত্তি জ্বালানির মতন আর কেউ রইল না।’ কথাগুলো বারবার বলে বিলাপ করে করছিলেন অগ্নিকাণ্ডে মারা যাওয়া পলি আক্তারের (৩৫) মা মরিয়ম বিবি (৫৫)।
সুনামগঞ্জের ধর্মপাশা উপজেলার জয়শ্রী ইউনিয়নের বরইয়া নদীর পাড়ের গ্রাম সীমের খাল। উপজেলা সদর থেকে এই গ্রামের দূরত্ব প্রায় ১৩ কিলোমিটার। গতকাল সোমবার মধ্যরাতে ওই গ্রামের একই পরিবারের জেলে এমারুল মিয়া (৪৫), স্ত্রী পলি আক্তার (৩৫), ছেলে পলাশ মিয়া (১০), ফরহাদ মিয়া (৮), ওমর ফারুক (৩) ও মেয়ে ফাতেমা আক্তার (৫) অগ্নিদগ্ধ হয়ে মারা যায়। মৃত্যুর খবর পেয়ে বিভিন্ন এলাকা থেকে ওই বাড়িতে লোকজন ছুটে আসছেন। গ্রামজুড়ে নেমে এসেছে শোকের ছায়া। আকস্মিক এই ঘটনায় গ্রামের সবাই হতবাক। আজ মঙ্গলবার দুপুরে সরেজমিনে ওই গ্রামে গিয়ে এই দৃশ্য দেখা গেছে।
সীমের খাল গ্রামের বাসিন্দা জেলে বাবুল মিয়া (৪৫) বলেন, ‘এমারুল মিয়া হাওরে মাছ ধইরা পরিবার চালাইত। ২০২১ সালে সরহারি ঘরে উডার আগে পরিবারের লোকজন লইয়া উপজেলার নওধার, বৌলাম ও হরিপুর গ্রামে আত্মীয়ের বাড়িতে থাকত। হেরার স্বামী-স্ত্রীর মইধ্যে কুনু ঝগড়া বিবাদ আছিইন না, হেরার ঋণও আছিইন না। ঘরের মধ্যে কারেন্ট আছিইন। কের লাইগ্যা যে আগুনে পুইড়া তারা মরল, বুইজা উঠতাম হারতাছি না।’
জেলে এমারুল মিয়ার বাবা কদ্দুস মিয়া (৭০) ও পলি আক্তারের বাবা চেরাগ আলী (৬০), নিজ ছেলে, মেয়ে ও নাতি–নাতনিদের মৃত্যুর শোকে অনেকটাই নিথর হয়ে গেছেন। তাঁরা শুধু বলছিলেন, ‘হেরা কিতা দোষ করছিইন, বেহেরেই আগুনে পুইড়া মরতে অইছে?’
পলি আক্তারের ছোট ভাই মনির মিয়া (২০) বলেন, ‘আমরার দুই ভাই ও দুই বইন আছিইন। বইন, বইনজামাই ও ভাইগনা, ভাগনি বেহেই আগুনে পুইড়া মরছে। কেরে যে হেরা বেহেই এক সাথে মরল, তা আমরা কেউ বুইজা উঠতাম হারতাছি না।’
প্রত্যক্ষদর্শী সাইফুল ইসলাম (৫০) বলেন, ‘আমি সোমবার রাইত ১২টার দিহে হাওরে মাছ মাইরা বাড়িত আইতে গিয়া দেহি, এমারুলের ঘরে দাউ দাউ কইরা আগুন জ্বলতাছে। আগুন আগুন কইয়া চিক্কুর দিছি। ঘরের ভিতরে দরজার সিটকারি মারা আছিইন। হরে বেহে মিইল্যা রাইত দুইটার দিহে আগুন নিভাইছি। ছয়জনের কেউরেই লাশ ছিনন যাইতাছে না।
উপজেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, উপজেলার জয়শ্রী ইউনিয়নের সীমের খাল গ্রামে ২০২১ সালে আশ্রয়ণ প্রকল্পের আওতায় ৩৪টি ঘর নির্মাণ করা হয়। এখানে ৩৪টি পরিবার বসবাস করে আসছে। অগ্নিদগ্ধের খবর পেয়ে আজ মঙ্গলবার সকাল সাড়ে সাতটার দিকে উপজেলার সীমের খাল গ্রামে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মোহাম্মদ গিয়াস উদ্দীন, ধর্মপাশা সার্কেলের সহকারী পুলিশ সুপার (এএসপি) আলী ফরিদ আহমেদ, ওসি মো. এনামুল হক ও জয়শ্রী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সঞ্জয় রায় চৌধুরী। বেলা একটার দিকে ঘটনাস্থল পরিদর্শনে আসেন সুনামগঞ্জের পুলিশ সুপার আ ফ ম আনোয়ার হোসেন খান।
ধর্মপাশা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. এনামুল হক মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, সিলেট থেকে সিআইডি ও পিবিআইয়ের টিম আলামত সংগ্রহ করার জন্য ঘটনাস্থলে রওনা হয়েছে। তারা আসার পর ছয়জনের মৃত্যুর সঠিক কারণ নির্ণয়ের জন্য লাশগুলো সুনামগঞ্জ জেলা সদর হাসপাতালের মর্গে পাঠানো হবে। তদন্ত অব্যাহত আছে।
ইউএনও মোহাম্মদ গিয়াস উদ্দীন বলেন, ‘অগ্নিদগ্ধ হয়ে একই পরিবারের ছয়জনের মৃত্যুর ঘটনায় আমরা মর্মাহত। লাশগুলো দাফনের জন্য উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে প্রয়োজনীয় অর্থ দেওয়া হবে।’