এখনো থোকায় থোকায় আম
বরেন্দ্রর ঢেউখেলানো ভূমি চাঁপাইনবাবগঞ্জের নাচোলে এই ভাদ্র মাসে একসময় তাল ছাড়া কোনো ফলই পাওয়া যেত না। আর এখন সেখানে গাছে গাছে দোল খাচ্ছে ‘ইলামতি’ আম। ইলা মিত্রের ‘ইলা’ আর দামি অর্থে ‘মতি’ নিয়ে নাম ধারণ করা সুস্বাদু আম এটি। দোল খেতে খেতে মায়া ছড়াচ্ছে ‘মায়াভোগ’। এ ছাড়া আছে থাইল্যান্ডের জাত কার্টিমন, থ্রিটেস্ট, আমেরিকান কেন্ট।
নতুন নতুন এসব নাবি জাত এসে লম্বা করছে আমের মৌসুম। নাচোলের কেন্দুয়া ও ঘাসুড়া গ্রামজুড়ে প্রায় ৫০০ বিঘা জমিতে আধুনিক পদ্ধতিতে আমবাগান করেছেন রফিকুল ইসলাম। কৃষিপণ্য উৎপাদন ও রপ্তানি শ্রেণিতে কৃষিক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি (এআইপি) হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছেন তিনি। তাঁর বাগান ঘুরে দেখা গেল এমন সাত প্রজাতির নাবি জাতের আম।
রফিকুল ইসলাম জানান, আধুনিক পদ্ধতিতে নাবি জাতের আম চাষ করেই এই স্বীকৃতি পেয়েছেন তিনি। রফিকুল বললেন, ‘একসময় এক বিঘা জমিতে ১৬টি প্রচলিত জাতের গাছ লাগানো হতো। সেখানে আমরা এখন ৩০০ গাছ লাগাচ্ছি। নতুন নতুন নাবি জাতের সব গাছ। এসব গাছই আশা জাগাচ্ছে আমচাষিদের মনে।’
আমের মৌসুম শেষ হয়ে যায় সাধারণত আষাঢ় মাসেই। অথবা শ্রাবণ মাসের প্রথম সপ্তাহেই। আশ্বিনা জাতের আম থাকলেও থাকে খুব কম; কিন্তু এখন ভাদ্র মাসের শেষ প্রান্তে এসেও গাছে গাছে ঝুলছে বিভিন্ন জাতের আম। নাবি জাতের আমচাষিদের দেওয়া তথ্যমতে, এর মধ্যে ইলামতি থাকবে সেপ্টেম্বরের মধ্যভাগ পর্যন্ত। মায়াভোগ সেপ্টেম্বরের শেষ পর্যন্ত। উষাপন্নি থাকবে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত। আমেরিকান কেন্ট ও থ্রিটেস্ট জাতের আম থাকবে অক্টোবরের মধ্যভাগ পর্যন্ত। আর কার্টিমন আম তো এখন প্রায় সারা বছর। মৌসুম শেষ হওয়ার পরও পাওয়া এসব আম বিক্রি হবে মৌসুমের চেয়ে অনেক বেশি দামে। মাত্র পাঁচ দিন আগেই শেষ হয়েছে গৌড়মতি আম। এ আমের ভালো দাম পাওয়া গেছে এবার।
চাঁপাইনবাবগঞ্জে আমের সবচেয়ে বড় মোকাম শিবগঞ্জ উপজেলায়। জেলার অন্য চার উপজেলায় যে আম উৎপাদিত হয়, তার থেকে বেশি হয় এক শিবগঞ্জ উপজেলাতেই। এখানে বড় বড় গাছের ফজলি, ল্যাংড়া, ক্ষীরশাপাতি, আশ্বিনা গাছই বেশি। এক গাছেই ২০-৩০ মণ থেকে ৫০ মণ পর্যন্ত ফলন হয়। আবার কোনো মৌসুমে একেবারে কম। কোনো মৌসুমে আমশূন্য গাছের সংখ্যাও অসংখ্য থাকে। এমন পরিস্থিতিতে আম্রপালি, বারি-৪, গৌড়মতির পাশাপাশি হালে ধুম পড়েছে কার্টিমন জাতের আম চাষে।
আমচাষিদের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি শিবগঞ্জ ম্যাঙ্গো প্রডিউসার কো-অপারেটিভ অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক ইসমাইল হোসেন খান জানালেন, আল্ট্রা হাই ডেনসিটি পদ্ধতিতে তৈরি কার্টিমন জাতের আমবাগান বাড়ছেই কেবল। শুধু তা–ই নয়, ১৫ থেকে ২০-২৫ বছর বয়সী গাছের ডাল ছাঁটাই করে (টপওয়ার্কিং) সেখানে স্থাপন করা হচ্ছে কার্টিমনের সায়ন বা উপযোগী কচি ডগা, যা হয়ে যাছে বড় কার্টিমনের গাছ। ফলনও পাওয়া যাচ্ছে আশানুরূপ। জাতটি বারোমাসি হওয়ায় কমবেশি ফলন দেয় তিনবার। তবে দুবার ফলন হয় ভালো।
ইসমাইল হোসেনের ভাষ্যে, এই আমের বড় বৈশিষ্ট্য হলো, কোন সময় ফলন নেওয়া হবে, তা চাষিরাই ঠিক করতে পারেন। অর্থাৎ মৌসুমের আম নিতে না চাইলে এর মুকুল ভেঙে দেওয়া হয়। কিছুদিন পর আবার আসে মুকুল—এভাবে পিছিয়ে যায় ফলনের সময়। এ জন্য আমচাষিদের মন জয় করে নিয়েছে কার্টিমন।
কার্টিমন প্রশংসা পাচ্ছে কৃষিবিদদের কাছেও। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, চাঁপাইনবাবগঞ্জের উপপরিচালক পলাশ সরকার বলছিলেন, কার্টিমন নামের থাইল্যান্ডের এই জাত বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছে। মৌসুমে এই আম কোনো ঝড়বৃষ্টির কবলে পড়ে না। রোগবালাই কম। এর সংরক্ষণ ক্ষমতাও বেশি। দামও পাওয়া যায় বেশি।
শুধু কার্টিমনই নয়, মায়াভোগ, গৌড়মতি, ইলামতিসহ নাবিজাতের আমগুলোই চাষিদের কাছে আশা ও ভরসার জায়গা।