খামারের সঙ্গে ভেসে গেছে স্বপ্ন

জেলার বিভিন্ন খামারের ভেসে যাওয়া মাছের পরিমাণ ৩০ হাজার মেট্রিক টন। সব মিলিয়ে এখন পর্যন্ত ক্ষতি হয়েছে প্রায় এক হাজার কোটি টাকার।

বন্যার পানিতে খামার থেকে মাছ ভেসে গেছে। ব্যাপক ক্ষতির মুখে খামারের মালিকেরা। ৬ জুলাই সুনামগঞ্জ সদরের বুড়িস্থল এলাকা থেকে তোলা
ছবি: আনিস মাহমুদ

সুনামগঞ্জের আবদুল আলীমের (৪২) মাছের খামারের ১৩ একর জমিতে বড় ৭টি পুকুর। এসব পুকুরে বিভিন্ন জাতের মাছ ছিল প্রায় ৩৫ লাখ টাকার। মাছ বিক্রির জন্য আলীম যখন প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন, তখনই ভয়াবহ বন্যার কবলে পড়ে সুনামগঞ্জ।

এক রাতেই বন্যার পানিতে সদর উপজেলার রঙ্গারচর গ্রামে আলীমের খামারের সব মাছ ভেসে যায়। ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে খামারের অবকাঠামো। এখন কীভাবে এই ক্ষতি পোষাবেন, সেই চিন্তায় দিশেহারা আবদুল আলীম।

শুধু আবদুল আলীমের একার নয়, সুনামগঞ্জে স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যায় জেলার প্রায় সব মাছচাষি ক্ষতির মুখে পড়েছেন। অনেকের ব্যাংকঋণ রয়েছে। দেনা আছে মাছের খাবারের দোকানেও। সরকারি ঋণ বা প্রণোদনা না পেলে এসব চাষি যে ঘুরে দাঁড়াতে পারবেন না সে কথা বলছেন খোদ মৎস্য বিভাগের কর্মকর্তারাও।

জেলা মৎস্য কর্মকর্তার কার্যালয়ের হিসাব অনুযায়ী, ১২টি উপজেলায় ২৫ হাজার ১৭৩টি পুকুর রয়েছে। এর মধ্যে মৎস্য অধিদপ্তরের অধীন ২০টি ও ভূমি মন্ত্রণালয়ের অধীন ১৫৩টি। বাকি ২৫ হাজার পুকুরে ব্যক্তিমালিকানায় মাছ চাষ করা হয়। জেলায় মাছচাষি আছেন ১৬ হাজার ৫০০ জন। এবারের বন্যায় সব পুকুরের মাছ ও পোনা ভেসে গেছে। ভেসে যাওয়া মাছের পরিমাণ ৩০ হাজার মেট্রিক টন। পোনা ভেসে গেছে প্রায় ১০ কোটি টাকার। সব মিলিয়ে এখন পর্যন্ত ক্ষতি হয়েছে প্রায় এক হাজার কোটি টাকার। এর মধ্যে অবকাঠামোর প্রায় ১০০ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে।

রঙ্গারচর গ্রামে আবদুল আলীম খামার গড়ে তুলতে ব্যাংক থেকে ১ কোটি ২৭ লাখ টাকা ঋণ নিয়েছেন। মাছের খাবার কেনার দোকানে দেনা আছে ১৫ লাখ টাকা। এখন বন্যায় সব মাছ ভেসে যাওয়ায় বিপাকে পড়েছেন তিনি। আলীম বলেন, ‘খামারের মাছ ভেসে গেছে। যত কাগজপত্র, ব্যাংকের চুক্তি, চেক, হিসাবপত্র ছিল, তা সবই পানিতে ভেসে গেছে। এই ভয়াবহ বন্যা আমাকে একেবারে নিঃস্ব করে দিয়ে গেছে।’

ব্যাংক থেকে ছয় লাখ টাকা নিয়ে সদর উপজেলার মনোহরপুরে মাছ ও কোয়েল পাখির খামার করেছিলেন মাহবুবুল আলম। দোকানে দেনা আছে সাড়ে চার লাখ টাকা। মাহবুবুল বলেন, এক টাকার মাছও বিক্রি করতে পারেননি। ১৫ লাখ টাকার ক্ষতি হয়ে নিঃস্ব হয়ে গেছেন। ব্যাংক তাগাদা দিচ্ছে ঋণের কিস্তি পরিশোধের জন্য।

জেলার দোয়ারাবাজার উপজেলার সুরমা ইউনিয়নের টেংরা গ্রামের বাসিন্দা মাছচাষি নুরুল ইসলাম জানান, তাঁর মাছের খামারের চারটি পুকুরের মাছ ও পোনা ভেসে গেছে। এসব পুকুরে রুই, কাতলা, পাঙাসসহ বিভিন্ন জাতের মাছ ছিল। মাছগুলোর প্রতিটির গড়ে ওজন ছিল দুই থেকে আড়াই কেজি।

নুরুল ইসলাম বলেন, বন্যায় অন্তত ২০ লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে। ১৯ একরের একটি পুকুরে শুধু বড় মাছ ছিল। সব ভেসে গেছে। এখন পথে বসার অবস্থা। ক্ষয়ক্ষতি ও ঋণ নিয়ে বিপাকে পড়ার কথা জানান একই এলাকার দীন ইসলাম, সিরাজুল ইসলাম, হাবিবুর রহমান ও আবদুর রহিম।

জেলায় মাছের খাবার বিক্রির ডিলারদের একজন ইসমাইল হোসেন। তিনি বলেন, ‘শুধু মাছচাষিরা নন, তাঁদের সঙ্গে আমরাও বিপাকে পড়েছি। চাষিদের কাছে লাখ লাখ টাকা পাওনা। অনেকে ক্ষতির বিষয়টি জানাচ্ছেন। সরকার থেকে মাছচাষিদের পাশে না দাঁড়ালে এই ক্ষতি কাটিয়ে ওঠা তাঁদের পক্ষে সম্ভব হবে না।’

এ বিষয়ে জেলা মৎস৵ কর্মকর্তা সুনীল মণ্ডল প্রথম আলোকে বলেন, এবারের মতো অতীতে কখনোই সুনামগঞ্জের মাছচাষিরা ক্ষতিগ্রস্ত হননি। সব জানিয়ে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে প্রতিবেদন দেওয়া হয়েছে। সরকারি কোনো সহযোগিতা বা প্রণোদনা এলে মাছচাষিরা তা পাবেন।