রূপসায় সালাম মুর্শেদীর ‘এমপি লীগ’ বনাম বাদশার ‘আওয়ামী লীগ’
সংসদ নির্বাচনের সময় যাঁরা নৌকার বিপক্ষে ছিলেন, তাঁদের কোণঠাসা করে রাখতে চাচ্ছেন বর্তমান সংসদ সদস্যের অনুসারীরা।
খুলনার রূপসা উপজেলা আওয়ামী লীগে অভ্যন্তরীণ কোন্দল চরম আকার ধারণ করেছে। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রকাশ্যে আসা এ দ্বন্দ্ব আসন্ন উপজেলা পরিষদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে আরও প্রকট হয়ে উঠেছে। নেতাদের বিরোধের কারণে দলের তৃণমূলে বিভক্তি আরও বাড়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। জেলা আওয়ামী লীগের নেতারাও অভ্যন্তরীণ বিভেদের কারণে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন।
দলীয় সূত্রে জানা গেছে, রূপসা উপজেলা আওয়ামী লীগ দুই পক্ষে বিভক্ত। একাংশের নেতৃত্ব দিচ্ছেন রূপসা উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও বর্তমান উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান কামাল উদ্দীন বাদশা। আরেকটি পক্ষে রয়েছেন খুলনা-৪ আসনের সংসদ সদস্য আবদুস সালাম মুর্শেদীর অনুসারীরা। তাঁরা একে অন্যের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে সংগঠনবিরোধী তৎপরতার অভিযোগ করছেন।
রূপসা উপজেলা আওয়ামী লীগ এরই মধ্যে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। রূপসা উপজেলায় ‘এমপি সাহেবের এমপি লীগ’ আর ‘আওয়ামী লীগ’ এই দুই ভাগে বিভক্ত। এটা আমাদের জন্য চরম ক্ষতির কারণ হয়ে যাচ্ছে। এমপি সাহেব নবাগত আওয়ামী লীগের লোকদের ব্যবহার করে সংগঠনকে কুক্ষিগত করার চেষ্টা করছেন।সুজিত কুমার অধিকারী, সাধারণ সম্পাদক, খুলনা জেলা আওয়ামী লীগ
জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সুজিত কুমার অধিকারী প্রথম আলোকে বলেন, ‘রূপসা উপজেলা আওয়ামী লীগ এরই মধ্যে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। রূপসা উপজেলা এমপি সাহেবের “এমপি লীগ” আর “আওয়ামী লীগ”—এই দুই ভাগে বিভক্ত। এটা আমাদের জন্য চরম ক্ষতির কারণ হয়ে যাচ্ছে। এমপি সাহেব আওয়ামী লীগের নবাগত লোকদের ব্যবহার করে সংগঠনকে কুক্ষিগত করার চেষ্টা করছেন।’
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে খুলনা-৪ আসনে আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থী ছিলেন আবদুস সালাম মুর্শেদী (নৌকা প্রতীক)। তাঁর বিরুদ্ধে দলীয় স্বতন্ত্র প্রার্থী হন সাবেক হুইপ ও জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক প্রয়াত এস এম মোস্তফা রশিদীর ভাই এস এম মোর্ত্তজা রশিদী দারা (কেটলি প্রতীক)। ওই নির্বাচনে রূপসা উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি কামাল উদ্দীন মোর্ত্তজা রশিদীর পক্ষে নির্বাচনী কার্যক্রম চালান। নির্বাচনে আবদুস সালাম মুর্শেদী ৮৬ হাজার ১৯৪ ভোট পেয়ে বিজয়ী হন। তাঁর নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী মোর্ত্তজা রশিদী পান ৬০ হাজার ৮৯৩ ভোট।
খুলনা জেলা ও রূপসা উপজেলা
আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পর্যায়ের অন্তত ১৫ নেতা-কর্মীর সঙ্গে কথা বলেছে প্রথম আলো। তাঁদের বক্তব্যে উঠে এসেছে, জাতীয় নির্বাচনে খুলনা-৪ আসনে যে বিভেদ তৈরি হয়েছে, সামনে উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে সেই দ্বন্দ্ব-বিভেদের চরম বহিঃপ্রকাশ ঘটতে পারে।
দলটির নেতারা বলছেন, গত ৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক দেখাতে আওয়ামী লীগ দলীয় প্রার্থীর বাইরে স্বতন্ত্র প্রার্থীর কৌশল নিয়েছিল। নির্বাচনে দলের নেতারা স্বতন্ত্র হিসেবে নির্বাচন করতে পারবেন, এ রকম ঘোষণার পর থেকে সংসদ সদস্য ও তাঁর পাল্টা পক্ষ দাঁড়িয়ে যায়। তৃণমূলে তৈরি হয় প্রকাশ্য বিভেদ। নির্বাচনের পর সেই বিভেদের রেশ এখনো চলছে। পক্ষগুলো নিজেদের প্রভাব ধরে রাখার চেষ্টার কারণে বিভেদ কমছে না। এ ছাড়া সংসদ নির্বাচনের সময়ে যাঁরা নৌকার বিপক্ষে ছিলেন, তাঁদের কোণঠাসা করে রাখতে চাচ্ছেন বর্তমান সংসদ সদস্যের অনুসারীরা।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে উপজেলা আওয়ামী লীগের এক নেতা বলেন, উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে কেউই মাঠ ছাড়তে চাইবেন না। উপজেলা পরিষদের বর্তমান চেয়ারম্যান আর সংসদ সদস্যের পছন্দের প্রার্থীকে নিয়ে দুটি পক্ষ থাকবে। এখনই বিবদমান পক্ষগুলোর মধ্যে সাংগঠনিকভাবে সমঝোতা না করতে পারলে এই কোন্দল তৃণমূলে স্থায়ী বিভেদ তৈরি করতে পারে।
সম্প্রতি রূপসা উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান কামাল উদ্দীন সংবাদ সম্মেলন করে অভিযোগ করেন, সংসদ নির্বাচনে জয়ী হওয়ার পর আবদুস সালাম মুর্শেদী স্বতন্ত্র প্রার্থীর সমর্থকদের গালাগাল ও হুমকি দিচ্ছেন। সংসদ সদস্য নেতাদের পদপদবি ‘খেয়ে ফেলা’র হুমকির পাশাপাশি স্বতন্ত্র প্রার্থীর পক্ষের নেতাদের সালাম দিতেও জনগণকে নিষেধ করেছেন বলে অভিযোগ করেন উপজেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি।
অভিযোগের ব্যাপারে সংসদ সদস্য সালাম মুর্শেদী প্রথম আলোকে বলেন, প্রায় সাত-আট বছর ধরে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন, জেলা পরিষদ নির্বাচন ও সংসদ নির্বাচনে ধারাবাহিকভাবে নৌকার বিপক্ষে কাজ করছেন মো. কামাল উদ্দীন। এ কারণে তিনি দলীয়ভাবে অনেকটা কোণঠাসা হয়ে পড়েছেন। দলের অধিকাংশ নেতা-কর্মী তাঁর সঙ্গে নেই। সামনে উপজেলা পরিষদ নির্বাচন। তাই তিনি সংসদ সদস্যের বিরুদ্ধে এসব অভিযোগ তুলে মানুষের ও দলের অনুকম্পা পাওয়ার চেষ্টা করছেন।
আবদুস সালাম মুর্শেদীর বিপক্ষে সংবাদ সম্মেলনের পরদিনই তাঁর অনুসারী রূপসা উপজেলা আওয়ামী লীগের একটি অংশের নেতা-কর্মীরা পাল্টা সংবাদ সম্মেলন করে কামাল উদ্দীনের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ তুলে ধরেন। সংবাদ সম্মেলনে উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক, সহসভাপতিসহ বেশ কয়েকজন নেতা উপস্থিত ছিলেন।
সালাম মুর্শেদীর অনুসারী রূপসা
উপজেলা আওয়ামী লীগের জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি ফ ম আবদুস সালাম বলেন, কামাল উদ্দীন দীর্ঘদিন দলের একই পদে থাকার পরও দলের সাংগঠনিক কর্মকাণ্ডে স্থবিরতা দেখা দিয়েছে। আওয়ামী লীগের দলীয় শৃঙ্খলাকে তিনি তাঁর কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে ভূলুণ্ঠিত করছেন।
দলীয় বিভেদের বিষয়ে জানতে চাইলে রূপসা উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি কামাল উদ্দীন প্রথম আলোকে বলেন, ‘এবারের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থীর পক্ষে অবস্থান নেওয়ায় সংসদ সদস্য আমার ওপর খেপেছেন। আমার কিছু বলার নেই। আমি জনগণের ভোটে নির্বাচিত আছি। তাঁরা চাইলে আবারও নির্বাচন করব। আর অন্য সব বিষয়ে নির্বাচনের পর কথা বলব।’
উপজেলা আওয়ামী লীগের বিভেদ নিরসনে জেলা আওয়ামী লীগের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন রাখা হয় জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সুজিত কুমার অধিকারীর কাছে। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘সংকট নিরসনের জন্য জেলা সভাপতিকে বলার চেষ্টা করেছি। জেলা সভাপতির সঙ্গে আমার মতানৈক্য হয় প্রতিনিয়ত। সমস্যা হচ্ছে, উনি (জেলা সভাপতি) সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দিতে চান। আমি চাই সবার মতের ভিত্তিতে কাজ করতে। সালাম সাহেবের বিরুদ্ধে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ব্যাপারে উনি দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভোগেন।’
অপরদিকে খুলনা জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হারুনুর রশিদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘দলের কেন্দ্র যে সিদ্ধান্ত নেবে, সেটাই আমাদের সিদ্ধান্ত। আর সাধারণ সম্পাদক নতুন মানুষ ; হয়তো আমার চেয়ে বড় নেতা হবেন; সময় লাগবে। তাঁর বিষয়ে কিছু বলার নেই। তাঁর অভিযোগ ভুয়া।’