অনলাইন উদ্যোক্তা হওয়ার স্বপ্ন দেখছেন রাজবাড়ীর গ্রামীণ নারীরা

রাজবাড়ীর পাঁচটি উপজেলার ৩২টি ইউনিয়নে অনুষ্ঠিত হয়েছে উঠান বৈঠক। জেলাটির বালিয়াকান্দি উপজেলার নবাবপুর ইউনিয়নের বেরুলী গ্রামের উঠান বৈঠকের একটি চিত্রছবি: প্রথম আলো

‘ইন্টারনেটের দুনিয়া সবার’ শীর্ষক প্রচারাভিযানের আওতায় সারা দেশের মতো রাজবাড়ী জেলায়ও চলছে উঠান বৈঠক। গ্রামীণ নারীদের ইন্টারনেটভিত্তিক জ্ঞান বাড়াতে এবং এর বহুমুখী ব্যবহার শেখাতে জেলার পাঁচটি উপজেলায় শুরু হয়েছে এ আয়োজন। গত ১৬ নভেম্বর রাজবাড়ীর বালিয়াকান্দি উপজেলার সদর ইউনিয়ন থেকে শুরু হয় উঠান বৈঠক। পর্যায়ক্রমে পাংশা, কালুখালী, রাজবাড়ী সদর এবং গোয়ালন্দ উপজেলার ৩২টি ইউনিয়নে অনুষ্ঠিত হয়েছে এ আয়োজন।

শুরুতেই ব্যাপক সাড়া মেলে গ্রামীণ নারীদের। বালিয়াকান্দি সদর ইউনিয়ন পরিষদের শেখ পাড়ার স্থানীয় আজমল হোসেনের বাড়িতে অনুষ্ঠিত হয় রাজবাড়ী জেলার প্রথম উঠান বৈঠক। এই বৈঠকে নারীদের আমন্ত্রণ জানানো ও তদারকির দায়িত্বে ছিলেন একই গ্রামের গৃহিণী মিতা খাতুন (৩২)। তাঁকে সহযোগিতা করেন রাজবাড়ী বন্ধুসভার সদস্যরা।

মিতা খাতুন। গ্রামের অন্য নারীদের নিয়ে সম্মিলিতভাবে উদ্যোক্তা হওয়ার পরিকল্পনা করছেন তিনি। মিতা রাজবাড়ীর বালিয়াকান্দি উপজেলার সদর ইউনিয়নের শেখপাড়া গ্রামের বাসিন্দা
ছবি: প্রথম আলো

মিতা খাতুনের দীর্ঘদিনের স্বপ্ন উদ্যোক্তা হওয়ার। তাঁর স্বামী লিটন মোল্লা পেশায় কৃষক। তাঁদের পাঁচ বছর বয়সী পুত্রসন্তান রয়েছে। অনুষ্ঠান শেষে কথা হয় মিতা খাতুনের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘আমার বাবার বাড়ি মাগুরা জেলার শালিখা থানার পুকুরিয়া গ্রামে। মাত্র দেড় বছর বয়সে মা মারা যান। কিছুদিন পর বাবা দ্বিতীয় বিয়ে করেন। পরিবারের অবহেলায় বাধ্য হয়ে নানাবাড়ি বালিয়াকান্দি উপজেলার পাইকান্দিতে চলে আসি। এখানকার স্কুল থেকেই এসএসসি এবং বালিয়াকান্দি ডিগ্রি কলেজ থেকে মানবিক বিভাগে এইচএসসি পাস করি। ডিগ্রি তৃতীয় বর্ষে পড়াকালীন আমার বিয়ে হয়। এরপর আর পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়া হয়নি।’

রাজবাড়ীর প্রথম আলো বন্ধুসভার সদস্য সাজ্জাদ হোসেন ও রাইসুল ইসলাম বাঁধনের কাছ থেকে উঠান বৈঠকের কথা জানতে পারেন মিতা। এরপর আনন্দের সঙ্গেই গ্রামের অন্য নারীদের তিনি আমন্ত্রণ জানান। পাশাপাশি নিজেও আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করতে থাকেন। মিতা খাতুন বলেন, ‘অনেক দিনের স্বপ্ন ছিল নিজে স্বাবলম্বী হব। এরপর গ্রামীণ নারীদেরও প্রতিষ্ঠিত করব। সেই লক্ষ্যেই যুব উন্নয়ন থেকে সেলাইয়ের ওপর প্রশিক্ষণ নিয়ে বাড়িতে বসে কাপড় কাটা, সেলাই করার কাজ করেছি। ইউটিউবে বিভিন্ন ভিডিও দেখে এবং উঠান বৈঠকের সঞ্চালক আপার কাছ থেকে ইন্টারনেটের বহুমুখী ব্যবহার সম্পর্কে জেনে আমার আগ্রহ আরও বেড়ে গেছে। এখন গ্রামের অন্য নারীদের নিয়ে সম্মিলিতভাবে উদ্যোক্তা হওয়ার পরিকল্পনা করছি।’

বালিয়াকান্দি উপজেলার সদর ইউনিয়নের উঠান বৈঠক শুরু হওয়ার কথা সকাল ১০টায়। নির্ধারিত সময়ের আগেই অনুষ্ঠানস্থল নারীদের অংশগ্রহণে পরিপূর্ণ হয়ে যায়। গ্রামটির প্রায় দেড় শ জন গৃহিণী ও স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থী এতে অংশ নেন। প্রিয়া রহমানের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানটি প্রাণচঞ্চল হয়ে ওঠে। নারীদের নানা সমস্যা নিয়ে স্বাস্থ্যবিষয়ক ভিডিও প্রদর্শন এবং বিষয়ভিত্তিক উদ্বুদ্ধকরণসহ চিত্র প্রদর্শনী চলে। এর ফাঁকে ফাঁকে চলতে থাকে বিষয়ভিত্তিক কুইজ প্রতিযোগিতা। কুইজে অংশ নিয়ে পুরস্কার জেতেন কলেজ-শিক্ষার্থী বিথী, শানু আক্তার এবং গৃহিণী লাবণী বেগম, আঞ্জুমানয়ারা বেগম ও মিতা আক্তার।

ইন্টারনেটের বহুমুখী ব্যবহার শেখাতে সারা দেশের দুই হাজার ইউনিয়নে চলছে ‘ইন্টারনেটের দুনিয়া সবার’ শীর্ষক আয়োজন।

রাজবাড়ী জেলা সদর থেকে প্রায় ৩৭ কিলোমিটার দূরে বালিয়াকান্দির নবাবপুর ইউনিয়ন। একই দিন বেলা তিনটায় উঠান বৈঠক হয় বেরুলী বাজারসংলগ্ন শারমিন সুলতানার বাড়িতে। সবুজ গাছপালায় ঘেরা নিরিবিলি পরিবেশে অনুষ্ঠিত উঠান বৈঠকে প্রায় ১৪০ জনের মতো বিভিন্ন বয়সী নারী অংশ নেন। বন্ধুসভার বন্ধু জারিনা সুবহা অনন্যার সঞ্চালনায় এক ঘণ্টাব্যাপী অনুষ্ঠানটিতে ছিল নানা বিষয়ের ওপর ভিডিও প্রদর্শনী এবং সংশ্লিষ্ট কুইজ। এসব কুইজ এবং বল খেলাসহ বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে পুরস্কার জেতেন কলেজ-শিক্ষার্থী সীমা খাতুন, গৃহিণী নাসিমা বেগম ও সাবিনা খাতুন।

রাজবাড়ীর সামগ্রিক আয়োজন নিয়ে বন্ধুসভার বন্ধু ও উঠান বৈঠকের দলনেতা সাজ্জাদ হোসেন বলেন, ‘প্রথম দিনেই এমন সাড়া পাব ভাবিনি। অনুষ্ঠান শেষ করেই অনেকে গ্রামীণ নারী আমাদের কাছে ইন্টারনেটের মাধ্যমে উদ্যোক্তা হওয়ার স্বপ্নের কথা জানিয়েছেন। বৈঠকে আসা নারীরা এর মাধ্যমে কিছুটা উপকৃত হলেও আমাদের উদ্যোগ ও পরিশ্রম সার্থক হবে।’

ইন্টারনেটের কল্যাণে গ্রামীণ নারীরা চলার পথে ছোটখাটো সমস্যার সমাধান নিজেরাই করতে পারবেন। সেই লক্ষ্যেই ‘ইন্টারনেটের দুনিয়া সবার’ শীর্ষক প্রচারাভিযানে আওতায় সারা দেশের দুই হাজার ইউনিয়নে চলছে উঠান বৈঠক। গ্রামীণফোনের উদ্যোগে এই আয়োজনের সহযোগিতায় রয়েছে প্রথম আলো, নকিয়া ও ঢাকা ব্যাংক। ২০২৩ সালের মার্চে শুরু হওয়া কার্যক্রমটির আওতায় গতকাল বুধবার (১১ ডিসেম্বর) পর্যন্ত ১ হাজার ৯৯০টি ইউনিয়নে উঠান বৈঠক সম্পন্ন হয়েছে।