রেস্তোরাঁটির প্রধান আকর্ষণ মাটির চুলায় রান্না হাঁসের মাংস
সিলেটের জৈন্তাপুর উপজেলার সারি নদীর ঠিক পারেই আধাপাকা টিনশেডের ছোট রেস্তোরাঁ। মূলত হাঁস আর দেশি মুরগির মাংসই এখানে রান্না হয়। সঙ্গে থাকে আলু ও মাছ ভর্তা। ডাল, সালাদ, লেবু ফ্রি। অবশ্য যে কেউ চাইলে আগেই অর্ডার দিয়ে স্থানীয় নদী-খাল-পুকুরের ছোট মাছের তরকারি কিংবা ভাজাও খেতে পারবেন। তবে গরম ভাতের সঙ্গে হাঁসের মাংস খেতেই মূলত এখানে ভোজনরসিকদের ভিড় জমে।
জৈন্তাপুর উপজেলা সদরে যাওয়ার প্রায় ছয় কিলোমিটার আগে সারি সেতু। এর সামান্য আগেই হাতের ডানে সিলেট-তামাবিল আঞ্চলিক মহাসড়কের ঢালুতে গাছগাছালি ঘেরা রেস্তোরাঁটির অবস্থান। বাইরে কোনো সাইনবোর্ড নেই। ভেতরে বড় বড় করে তিনটি ডিজিটাল ব্যানারে লেখা, ‘সুরুচি ভাতের হোটেল’। রেস্তোরাঁটি প্রতিদিন সকাল ১০টা থেকে রাত ৩টা পর্যন্ত খোলা থাকে। এর স্বত্বাধিকারী জৈন্তাপুর উপজেলার নয়াখালী গ্রামের সাবুল দাশ (৫০)।
রেস্তোরাঁটিতে খেয়েছেন, এমন দুজন জানালেন, কিছুটা ঝাল ঝাল মাংস এখানে রান্না হয়। গ্রামের বাড়িতে মাটির চুলায় যে ধরনের রান্না হয়, সেভাবেই এখানে রান্না হয়। গ্রামীণ পরিবেশে গ্রামীণ রান্নার স্বাদ নিতেই মূলত ভোজনরসিকেরা এখানে ছুটে আসেন। জাফলং, তামাবিল ও শ্রীপুরগামী পর্যটক এবং ট্রাকচালক থেকে শুরু করে বিভাগীয় শহর সিলেট থেকেও মানুষ এই গ্রামীণ রান্নার স্বাদ নিতে এখানে প্রতিদিন ভিড় জমান।
সুরুচি ভাতের হোটেলে দুই প্লেট ভাতের সঙ্গে হাঁস কিংবা দেশি মুরগির মাংসের একেক বাটির দাম ২০০ টাকা। এর সঙ্গে ডাল, শসা কিংবা ক্ষীরার সালাদ আর স্থানীয় পাহাড়ি লেবু ফ্রি। কেউ চাইলে ১০ টাকা দিয়ে আলু ভর্তা এবং ২০ টাকা দিয়ে মাছভর্তাও পাতে নিতে পারেন। একসঙ্গে রেস্তোরাঁটিতে ৪০ জন বসে খেতে পারেন। বিশেষ করে শুক্রবার ও শনিবার দিনরাত এখানে ভোজনরসিকদের ভিড় বেশি থাকে। গড়ে দেড় শ মানুষ প্রতিদিন আসেন বলে রেস্তোরাঁর বিক্রয়কর্মীরা জানালেন।
আবদুল হাদী (১৮) পাঁচ বছর ধরে রেস্তোরাঁয় খাবার পরিবেশনকারীর কাজ করছেন। তিনি জানান, এখানে পালাক্রমে ১৫ জন কর্মচারী ও বাবুর্চি কাজ করেন। হাঁস ও মুরগির মাংসের পাশাপাশি অর্ডার অনুযায়ী ছোট-বড় মাছের ভাজা ও তরকারি রান্না করা হয়। শীতের মৌসুমে বেসন দিয়ে লাউফুল বড়া, বেগুনভাজা আর শাকসবজিসহ নানা আয়োজনও করা হয় ভোজনরসিকদের চাহিদা অনুযায়ী। টাটকা খাবারের জন্যই মূলত এ রেস্তোরাঁর সুনাম ছড়িয়েছে।
রেস্তোরাঁর স্বত্বাধিকারী সাবুল দাশ জানান, একসময়ে তিনি বালু-পাথরের ব্যবসা করতেন। ২০১০ সালের দিকে রেস্তোরাঁটি চালু করেন। শুরুতে নিজেই রান্না করতেন। মাটির চুলায় তাঁর এখানে রান্নাবান্না হয়। এখন তিনিসহ আরেকজন বাবুর্চি রান্না করেন। নিজ বাড়িতে যেভাবে ঘরোয়া খাবার রান্না করা হয়, তাঁরাও রেস্তোরাঁতে একইভাবে রান্নার চেষ্টা করেন। এ কারণে খাদ্যপ্রেমীরা এখানে খেতে নিয়মিত আসেন। কোনো ধরনের প্রচার-প্রচারণা ছাড়াই কেবল সুস্বাদু খাবারের গুণেই রেস্তোরাঁটি পরিচিতি পেয়েছে।
৯ অক্টোবর সন্ধ্যা ছয়টার দিকে রেস্তোরাঁটিতে গিয়ে দেখা যায়, কয়েকজন বসে মাংস দিয়ে ভাত খাচ্ছেন। এ সময় হাঁস ও মুরগির মাংস এবং আলু ও মাছভর্তা আর ডালের স্বাদ পরখ করেন এ প্রতিবেদকও। প্রতিটি খাবারই সুস্বাদু। আলু ও মাছভর্তা করা হয়েছে শর্ষের তেল ও পোড়া শুকনো মরিচ দিয়ে। এ ছাড়া হাঁস ও মুরগির মাংস রয়েছে। মাংসে ঝাল একটু বেশি, যা স্বাদ অনেকটাই বাড়িয়েছে।
রেস্তোরাঁয় প্রতিদিন ২০–২৫টি হাঁস এবং ৮–১০টি মুরগি এখানে রান্না হয়। কেউ চাইলে চামড়াসহ হাঁসের মাংস এখানে খেতে পারবেন। চামড়াসহ যাঁরা হাঁসের মাংস খান, তাঁদের জন্য হাঁসের পাখপাখালি ফেলে শরীরের রোম আগুনের তাপে পুড়িয়ে তবেই রান্নার উপযোগী করা হয়।
বাবুর্চি মোহাম্মদ বাবুলকে (৬৩) দেখা গেল রান্নাঘরে মাটির চুলার পাশে নুয়ে দুই হাত দিয়ে পাখপাখালি ফেলে দেওয়া একটি হাঁসের রোম আগুনে পোড়াচ্ছেন। তিনি জানান, এ রেস্তোরাঁর প্রতিটি খাবারই ঘরের মতো রান্না করা হয়। এই টানেই সবাই খেতে আসেন। তাঁরাও সব সময় রান্নার মান ধরে রাখার চেষ্টা করেন। পাশাপাশি প্রত্যেককেই তাঁরা গরম ধোঁয়া-ওড়া ভাত আর তরকারি সরবরাহের চেষ্টা করেন। এতে সবাই তৃপ্তি নিয়ে খান।