কাঠচোর চক্রের থাবায় উজাড় হচ্ছে টেংরাগিরি বন

টেংরাগিরি বন থেকে গাছ কেটে পাচার করছে সংঘবদ্ধ চক্র। এসব গাছের গুঁড়িও পুড়িয়ে ফেলতে সম্প্রতি বনে আগুন দেয় চক্রটি। সম্প্রতি বেহুলার চর এলাকায়ছবি: প্রথম আলো

আধা কিলোমিটারজুড়ে কেটে নেওয়া গাছের গুঁড়িগুলো দাঁড়িয়ে আছে শ্বাসমূলের মতো। সেসব গুঁড়িও পুড়ে কয়লা। আশপাশের সবুজ গাছগুলোর পাতা আগুনের তাপে শুকিয়ে গেছে। এদিক-সেদিক উপড়ে পড়ে আছে অসংখ্য গাছ। পুরো এলাকা যেন এক ধ্বংসস্তূপ।

সম্প্রতি টেংরাগিরি বনের বেহুলার চর এলাকায় গিয়ে এমন দৃশ্য দেখা গেল। স্থানীয় মানুষ ও বন কর্মকর্তারা বলছেন, বনের গাছ কেটে পাচারের পর আলামত ধ্বংস করতে আগুন দিয়ে এমন ধ্বংসযজ্ঞ চালায় কাঠচোর চক্র। সম্প্রতি বনের দুটি এলাকায় আগুনে পুড়ে গেছে কয়েক হাজার গাছ। এ ঘটনায় মামলা করেছে বন বিভাগ।

সুন্দরবনের পর দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম শ্বাসমূলীয় (ম্যানগ্রোভ) বন টেংরাগিরি। বরগুনার তালতলী উপজেলায় বঙ্গোপসাগরের কোল ঘেঁষে এই বনের অবস্থান। বৈশ্বিক উষ্ণায়নের ফলে উপকূলে লবণাক্ততার আগ্রাসন, সমুদ্রের তলদেশের উচ্চতা বেড়ে যাওয়ায় প্লাবনভূমির সম্প্রসারণ এবং ভাঙনে এমনিতেই এই বনাঞ্চল নানামুখী হুমকিতে পড়েছে। তার ওপরে সংঘবদ্ধ কাঠচোরের উৎপাতে উজাড় হচ্ছে বন।

বন বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, তালতলী থেকে পটুয়াখালীর কুয়াকাটা পর্যন্ত বিস্তৃত এই বনাঞ্চলের আয়তন ১৩ হাজার ৬৪৪ একর। একসময় যা সুন্দরবনের অংশ ছিল। ১৯৬৭ সালে টেংরাগিরি বন নামে সরকারি গেজেটভুক্ত হয়। সরকারি নথিতে টেংরাগিরি থাকলেও স্থানীয়ভাবে এটি ফাতরার বন নামে পরিচিত। বড় নিশানবাড়িয়া ও সখিনা দুটি বিট নিয়ে এই বনাঞ্চল প্রকৃতি ও জীববৈচিত্র্যের অমূল্য এক আঁধার। লবণাক্ত ও মিষ্টি মাটির মিশ্রণের কারণে প্রচুর জাম, ধুন্দুল, কেওড়া, সুন্দরী, বাইন, করমচা, বলই কেওয়া, তাল, বনকাঁঠাল, রেইনট্রি ও গরানগাছ আছে।

স্থানীয় বাসিন্দারা বলছেন, বন থেকে দীর্ঘদিন ধরেই গাছ কেটে পাচার করছে সংঘবদ্ধ চোরচক্র। এই চক্রের সঙ্গে বন বিভাগের লোকজনের সম্পৃক্ততা রয়েছে বল অভিযোগ তাঁদের।

গত ২৫ মার্চ বন বিভাগ খবর পায়, বেহুলার চরে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। তবে স্থানীয় ব্যক্তিদের ধারণা, আগুন লাগে আরও আগে। খবর পাওয়ার প্রায় ১৮ ঘণ্টা পর স্থানীয়দের সহায়তায় আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে বন বিভাগ। আগুনে সাগরতীর থেকে আধা কিলোমিটার ভেতর পর্যন্ত বনের গাছ পুড়ে যায়।

টেংরাগিরি বনের বেহুলার চর এলাকার প্রায় আধা কিলোমিটার এলাকার অন্তত তিন হাজার গাছ কেটে নিয়ে গেছে চোরচক্র
ছবি: প্রথম আলো

সম্প্রতি সরেজমিনে দেখা যায়, বনের দক্ষিণ দিকের শেষ সীমানায় সোনাকাটা ইউনিয়নের সকিনা গৌয়ামতলা এলাকার বেহুলার চরে প্রায় আধা কিলোমিটার এলাকা পুড়ে গেছে। সেখানে অন্তত তিন হাজার গাছ কেটে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। তবে গাছের গুঁড়িগুলো দাঁড়িয়ে আছে। আগুনে অনেক গাছ পুড়ে যাওয়ার পাশাপাশি তাপে শুকিয়ে গেছে অসংখ্য গাছ।

ওয়াটার্স কিপার ও টেংরাগিরি বনাঞ্চল সুরক্ষা কমিটির তালতলী উপজেলার সমন্বয়ক আরিফুর রহমান পুড়ে যাওয়া ওই এলাকা পরিদর্শন করেছেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, বনটি ছিল সুন্দরী ও গড়ানগাছের। সেখানে অন্তত তিন গাজার গাছ কেটে নেওয়া হয়েছে। আগুনে পুড়েছে অন্তত ১০ হাজার গাছ। অসংখ্য গাছ আগুনে শুকিয়ে গেছে। আগুন লাগার বিষয়টি বন বিভাগকে জানানো হলে তাঁরা ১৮ ঘণ্টার পর সেখানে গিয়ে আগুন নেভানোর কাজ শুরু করেন। এতে বনের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে।

অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় পাশের কলাপাড়া উপজেলার মহিপুর এলাকার তিনজনকে আসামি করে আমতলী ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে একটি মামলা করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন বড় নিশানবড়িয়া বিট কর্মকর্তা হায়দার আলী। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, বনে যত গাছ কাটা বা আগুন দেওয়ার কাজ ওই পাড়ের (কলাপাড়ার মহিপুর) লোকজন করে। এবার আগুন দেওয়ার ঘটনায় যাঁদের আসামি করা হয়েছে, তাঁদের নামে আগেও অসংখ্য মামলা রয়েছে।

এই বনাঞ্চল যেকোনো বড় ঝড়ের গতি মন্থর করে দিতে দুর্দান্ত কাজ করে। সুন্দরবনের মতোই আরেক আশীর্বাদ এই বন।
অধ্যাপক আলমগীর কবির, পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি বনায়ন বিভাগের প্রধান

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মামলার তিন আসামি হলেন মোশারেফ হোসেন (৪৬), হারুন হাওলাদার (৪৮) ও ফজলু মিয়া (৪০)। বন বিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন, তাঁরা কাঠ চুরি ও পাচারের সঙ্গে দীর্ঘদিন ধরেই জড়িত। গত তিন বছরে শুধু নিশানবাড়িয়া বিটে গাছ চুরির ঘটনায় ২০টি মামলা হয়েছে। অধিকাংশ মামলায় এই তিনজন আসামি। তবে বিচার শেষ না হওয়ায় কোনো মামলায় তাঁদের শাস্তি হয়নি।

চক্রটি কলাপাড়া উপজেলার হওয়ায় অনেক ব্যবস্থা নেওয়া যায় না বলে দাবি বিট কর্মকর্তা হায়দার আলীর। বন রক্ষায় উদাসীনতার অভিযোগ অস্বীকার করে তিনি বলেন, ‘আমরা সব সময়ই বন সুরক্ষায় তৎপর আছি। তবে জনবল ও যানবাহনসংকটের কারণে অনেক সমস্যা হচ্ছে।’

বনে দ্বিতীয় আগুনের ঘটনা ঘটে গত ১১ এপ্রিল ঈদুল ফিতরের দিন। ওই দিন সখিনা বিটের ডিসিরকিল্লা এলাকার বনে আগুন লাগে। তবে তাৎক্ষণিক বিষয়টি জানার পর বন বিভাগ ও স্থানীয় লোকজন মিলে আগুন নিভিয়ে ফেলেন। এতে বড় ধরনের ক্ষতি হয়নি। বিট কর্মকর্তা মোশারফ হোসেন ধারণা করছেন, জেলেদের সিগারেটের আগুনে ওই অগ্নিকাণ্ডের সূচনা হয়েছে। তবে এতে বেশি ক্ষতি হয়নি। কিছু গাছ আগুনের তাপে ঝলসে গেছে।

সংঘবদ্ধ কাঠচোরের উৎপাতে উজাড় হচ্ছে টেংরাগিরি বন
ছবি: প্রথম আলো

স্থানীয় বাসিন্দা দুলাল মিয়া বলেন, ১৫-২০ বছর ধরেই টেংরাগিরি বনে আগুন দেওয়ার প্রবণতা চলছে। তবে এবার বেহুলার চর এলাকায় আগুনের তীব্রতা আগেরগুলোর চেয়ে ভয়াবহ ছিল। তিনি বলেন, আগে বড় বড় গাছের বাকল, ডালপালা ছেঁটে গাছ হত্যা করা হতো। এ ছাড়া আগুন দিয়ে গাছের গোড়ার অংশ পুড়ে ফেলা হতো। এরপর যখন গাছ মারা যেত, তখন কেটে নিয়ে যেত পাচারকারীরা। বন বিভাগের লোকজনের উদাসীনতা এবং অসাধু কিছু কর্মকর্তার যোগসাজশে এসব কাঠ পাচার হচ্ছে।

স্থানীয় মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, টেংরাগিরি বনের কাঠ পাচারকে কেন্দ্র করে চারটি চক্র সক্রিয়। তারা সবাই কলাপড়ার মহিপুর এলাকার বাসিন্দা। প্রতিটি চক্রে ১৫ থেকে ২০ জন সদস্য রয়েছে। তারা বনের ভেতরে ঢুকে প্রথম নির্বিচার গাছ কাটে। পরে রাতে ট্রলার ভর্তি করে সেসব কাঠ নিয়ে যায়। এসব কাঠের অধিকাংশ যায় ঢাকার বিভিন্ন হার্ডবোর্ড ও কাগজ মিলে। এ ছাড়া স্থানীয় ইটভাটা ও করাতকলেও যায় বিপুল পরিমাণ কাঠ।

তালতলী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সিফাত আনোয়ার সম্প্রতি প্রথম আলোকে বলেন, বেহুলার চরে বনের ভেতরে কাটা গাছের গুঁড়ি আছে। এই গুঁড়িগুলো মুছে ফেলার জন্যই আগুন দেওয়া হয়েছে। বনের ভেতরে কয়েক হাজার গাছ কাটা হয়েছে। বনের গাছ নিয়ে হরিলুট চলছে। অল্প সময়ের মধ্যে সরেজমিন পরিদর্শনের প্রতিবেদন ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে জমা দেবেন।

আমতলী-তালতলী রেঞ্জ কর্মকর্তা মো. মতিয়ার রহমান বলেন, বেহুলার চরে দুর্বৃত্তদের দেওয়া আগুনে বনের অনেক গাছ পুড়ে গেছে। অসংখ্য গাছ আগুনের তাপে শুকিয়ে মারা যাচ্ছে। কেটে নেওয়া অনেক গাছের গোরা পড়ে আছে। আগুন দেওয়ার ঘটনায় বন আইনে তিন ব্যক্তিকে আসামি করে মামলা করা হয়েছে উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, ‘আমি এখানে নতুন যোগদান করেছি। বন সুরক্ষায় কোনো ধরনের অনিয়ম ও উদাসীনতা বরদাশত করা হবে না।’

পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি বনায়ন বিভাগের প্রধান অধ্যাপক আলমগীর কবির প্রথম আলোকে বলেন, এই বনাঞ্চল যেকোনো বড় ঝড়ের গতি মন্থর করে দিতে দুর্দান্ত কাজ করে। সুন্দরবনের মতোই আরেক আশীর্বাদ এই বন। অতীতে দেখা গেছে, সিডর, আইলাসহ প্রতিটি ঘূর্ণিঝড়ে সুন্দরবন প্রথমে বুক পেতে ঝড়ের গতি মন্থর করেছে। টেংরাগিরিও তেমন নিরাপত্তা দিচ্ছে। দুর্যোগ মোকাবিলায় এ ধরনের বন সংরক্ষণের পাশাপাশি পরিধি বাড়ানো জরুরি।