প্রায় চার মাস পর কক্সবাজার সমুদ্রসৈকত থেকে লাল নিশানা সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। গতকাল বৃহস্পতিবার থেকে এর পরিবর্তে উড়ছে লাল-হলুদ নিশানা। বর্ষা মৌসুমে সাগর উত্তাল হয়ে পড়া এবং তলদেশে গুপ্তখাল তৈরি হওয়ায় গত ১৩ জুলাই থেকে কক্সবাজার সমুদ্রসৈকতের পাঁচ কিলোমিটার এলাকায় লাল নিশানা উড়ানো হয়েছিল। সমুদ্রসৈকতে বেড়াতে আসা পর্যটকেরা যাতে সাগরে গোসল করতে না নামেন, তারই নির্দেশনা হিসেবে লাল নিশানা ওড়ানো হয়। তবে বর্তমানে সাগর শান্ত এবং পর্যটকদের জন্য নিরাপদ হওয়ায় লাল নিশানা প্রত্যাহার করে এখন লাল-হলুদ নিশানা ওড়ানো হচ্ছে।
সমুদ্রসৈকতে নিয়োজিত লাইফগার্ড কর্মী ও পুলিশ সদস্যরা জানান, চার মাস ধরে সাগর উত্তাল ছিল। এ সময় সমুদ্রসৈকতে লাল নিশানা থাকলেও অনেক পর্যটক গোসল করতে নেমেছেন। এতে বেশ কিছু প্রাণহানির ঘটনাও ঘটেছে।
গত ২৬ অক্টোবর দুপুরে সৈকতের সুগন্ধা পয়েন্টে গোসলে নেমে মারা যান মাহমুদুর রহমান (১৬) নামে মাদ্রাসাপড়ুয়া এক শিক্ষার্থী। বন্ধুদের সঙ্গে সাগরে গোসল করতে নামার পর স্রোতে ভেসে যায় সে। পরে লাইফগার্ডের কর্মীরা তার মরদেহ উদ্ধার করে। সৈকতের সি গাল পয়েন্টে ২১ অক্টোবর দ্রুতগতির জলযান জেট স্কি থেকে পড়ে মামুন হাওলাদার (৩২) নামে এক পর্যটকের মৃত্যু হয়। প্রচণ্ড ঢেউয়ের তোড়ে জেট স্কি কাত হয়ে গেলে তিনি সাগরে পড়ে যান। এর আগের দিন কলাতলী পয়েন্টে গোসলে নেমে মারা যান মো. সায়মন নামের আরেক তরুণ। লাইফগার্ডের তথ্যমতে, গত ১০ মাসে সৈকতে গোসল করতে নেমে মৃত্যু হয়েছে ৮ পর্যটকের। স্রোতের টানে ভেসে যাওয়ার সময় উদ্ধার করা হয়েছে অন্তত ১২০ জনকে।
লাইফগার্ড কর্মীরা বলেন, ঘূর্ণিঝড় ও বৈরী পরিবেশের প্রভাবে সাগর উত্তাল হলে ঢেউগুলোর উচ্চতা স্বাভাবিকের চেয়ে ৮-৯ ফুট বৃদ্ধি পায়। সাগরের তলদেশেও গুপ্তখাল ও গর্ত তৈরি হয়। এসব গর্ত বা খালে কেউ আটকে গেলে তাকে উদ্ধার করা কঠিন হয়ে পড়ে। ফলে প্রাণহানির ঘটনা ঘটে।
গতকাল বৃহস্পতিবার বিকেলে সরেজমিনে দেখা গেছে, সমুদ্রসৈকতের সুগন্ধা, কলাতলী, সি গাল ও লাবণী পয়েন্টের কয়েকটি স্থানে লাল-হলুদ নিশানা উড়ছে। সমুদ্রও বেশ শান্ত। লাইফগার্ড কর্মীরা জানান, সকাল থেকে বেলা তিনটা পর্যন্ত অন্তত ৩০ হাজার পর্যটক সমুদ্রের পানিতে নেমে গোসল করেছেন।
সমুদ্রসৈকতে কথা হয় ঢাকার রমনা এলাকার কাপড় ব্যবসায়ী সাজ্জাদুল করিমের সঙ্গে। তিনি সকালে স্ত্রী ও দুই ছেলে-মেয়ে নিয়ে কক্সবাজার পৌঁছান। উঠেছেন কলাতলী এলাকার একটি রিসোর্টে। বিকেলে তিনি পরিবারের সদস্যদের নিয়ে সৈকতের সুগন্ধা পয়েন্টে নামেন। সেখানে বালুচরে বসানো ছাতা–চেয়ারে (কিটকটে) বসে ছিলেন তিনি। সাজ্জাদুল করিম বলেন, দুই বছর আগে জুলাই মাসে এসে উত্তাল সমুদ্রের রূপ উপভোগ করেছেন। এবার সাগর একেবারেই শান্ত। আগেরবার লাল নিশানা উড়তে দেখে গোসলে নামতে মনে ভয় জেগেছিল। তবে এবার লাল-হলুদের নিশানা উড়তে দেখে ভালো লাগছে, মনের শঙ্কাও দূর হয়েছে।
চট্টগ্রামের নাজিরহাটের ব্যবসায়ী কুদরত উল্লাহ (৪৫) বলেন, পর্যটকেরা কক্সবাজার ভ্রমণে আসেন সমুদ্রের টানে। দেশের অনেক জেলার মানুষ সমুদ্র দেখেননি। জীবনে একবার হলেও সমুদ্র দর্শনের ইচ্ছা তাঁদের মনে গেঁথে থাকে। সমুদ্রের লোনা জলে শরীর ডুবানোর আগ্রহ থাকে অনেকের। কিন্তু সৈকতে এসে যদি তাঁদের কেউ লাল নিশানা উড়তে দেখেন, তখন চরম হতাশ হন। যদিও অনেকে নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে গোসলে নেমে বিপদে পড়েন।
কলাতলী থেকে লাবণী পয়েন্ট পর্যন্ত পাঁচ কিলোমিটার সৈকতে গোসলে নেমে কোনো পর্যটক ভেসে গেলে বা নিখোঁজ হলে তাঁদের উদ্ধার করেন বেসরকারি সি-সেফ লাইফগার্ডের ২৭ জন কর্মী। সকাল ৭টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত পালাক্রমে দায়িত্ব পালন করেন তাঁরা। পর্যটকের সার্বিক নিরাপত্তার জন্য নিয়োজিত রয়েছেন জেলা প্রশাসনের নিয়োগ করা আরও ৩৭ জন স্বেচ্ছাসেবী-বিচ কর্মী।
কলাতলী থেকে টেকনাফ পর্যন্ত ১১৫ কিলোমিটার সৈকতে গোসলে নেমে কেউ নিখোঁজ বা স্রোতের টানে গভীর সাগরের দিকে ভেসে গেলে উদ্ধারের কেউ থাকে না। সেখানেও কোনো নিশানাও ওড়ানো হয় না। প্রতিদিন হাজারো পর্যটক সৈকতের হিমছড়ি, ইনানী, পাটোয়ারটেক, বাহারছড়া ও টেকনাফ সৈকতে গোসল করেন।
সি-সেফ লাইফগার্ডের সুপারভাইজার সাইফুল্লাহ সিফাত প্রথম আলোকে বলেন, শীত মৌসুম শুরু হওয়ায় সাগর এখন শান্ত। পানির নিচের গুপ্তখাল ও গর্ত ভরাট হয়ে গেছে। তাই পর্যটকদের গোসলে নামতে কোনো সমস্যা নেই। বৃহস্পতিবার থেকে লাল-হলুদ নিশানা ওড়ানো হচ্ছে। সাগরে লঘুচাপ-নিম্নচাপসহ কোনো দুর্যোগ দেখা দিলে আবারও পর্যটকদের নিরাপত্তার কথা বিবেচনা করে লাল নিশানা ওড়ানো হবে।
সি-সেফ লাইফগার্ডের মাঠ প্রকল্প ব্যবস্থাপক ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন, সাগর শান্ত দেখে অনেক পর্যটক সৈকতের হিমছড়ি, ইনানী, পাটোয়ারটেক সৈকতে গোসলে নামছেন। তবে এসব এলাকা প্রাকৃতিক পাথরে ভর্তি। গোসলের সময় পাথর থেকে পা পিছলে আঘাত পাওয়া কিংবা অসাবধানতাবশত পাথরখণ্ডের ফাঁকে ডুবে যাওয়ার শঙ্কা রয়েছে। সেখানে উদ্ধার তৎপরতা চালানো খুবই ঝুঁকিপূর্ণ কাজ। তাই এ ক্ষেত্রে সবার সতর্কতা প্রয়োজন।