‘আফসোস নাই, দেশের জন্য গুলি খাইছি’
বৈষ্যমবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে গিয়ে গুলিতে আহত হয়েছেন আবদুল আহাদ (২২)। তিনি বর্তমানে কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতালের ১ নম্বর ওয়ার্ডে (অর্থপেডিক) চিকিৎসাধীন। গতকাল মঙ্গলবার সন্ধ্যায় হাসপাতালে আলাপকালে তিনি বলেন, ‘আফসোস নাই, দেশের জন্য গুলি খাইছি।’
আহত আবদুল আহাদ কুষ্টিয়া সদর উপজেলার হরিপুর গ্রামের মোহাম্মদ শহিদ ও রোজিনা বেগম দম্পতির ছেলে। রোজিনা মানুষের বাসাবাড়িতে গৃহকর্মীর কাজ করেন। আর তাঁর স্বামী মোহাম্মদ শহিদ অসুস্থ হয়ে বাড়িতে থাকেন। এই দম্পতির দুই সন্তানের মধ্যে বড় ছেলে আবদুল আহাদ কুষ্টিয়া শহরে থানা মোড়ে দুই বছর ধরে ঝালমুড়ি বিক্রি করে আসছিলেন। ছোট ছেলে পঞ্চম শ্রেণির ছাত্র। দুই বছর আগে আহাদ বিয়ে করেছেন। তাঁর স্ত্রী রিয়া আক্তার সাত মাসের অন্তঃসত্ত্বা।
গতকাল সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টার দিকে হাসপাতালে গিয়ে আহাদের মা রোজিনা বেগম ও ছোট ভাই নূর ইসলামকে বিছানার পাশে বসে থাকতে দেখা যায়। তবে বিছানায় ছিলেন না আহাদ। রোজিনা বললেন, হাসপাতাল চত্বরে হাঁটতে বের হয়েছে আহাদ। চিকিৎসক প্রতিদিন কিছু সময় হাঁটার পরামর্শ দিয়েছেন।
কিছুক্ষণ পর বিছানায় চলে আসেন আহাদ। তাঁর বিছানার পাশে টাঙিয়ে রাখা হয়েছে ছোট আকারের বাংলাদেশের পতাকা। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনকারী ছাত্ররা এই পতাকা বেঁধে দিয়ে গেছেন বলে জানালেন আহাদ। তিনি বলেন, ৪ আগস্ট আন্দোলনে গিয়েছিলেন, সেদিন পায়ে ও হাতে হালকা ছররা গুলি লেগেছিল, পরে বাড়িতেই ছিলেন। তবে ৫ আগস্ট দুপুরে জানতে পারেন, শহরে আবার আন্দোলন শুরু হয়েছে, তখন বাড়ি থেকে আবার বের হন। থানা মোড়ে থানার গেটের সামনে পায়ে আবারও ছররা গুলি লেগে তিনি গুরুতর আহত হন।
৫ আগস্ট কুষ্টিয়া শহরে আন্দোলনে সংঘর্ষ ও সংঘাতে শতাধিক শিক্ষার্থী আহত হন। নিহত হন আটজন। গুলিবিদ্ধ আহাদ সেদিন থেকেই কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। কথা বলার একপর্যায়ে পা দেখিয়ে মৃদু হেসে আহাদ বললেন, ‘দেখছেন, ছররা গুলিতে ডান পায়ের হাঁটুর ওপরে কীভাবে ঝাঁঝরা হয়ে গেছে। হাসপাতালে ভর্তির পর পাশে থাকা আহত দুজনকে মরতে দেখেছি। আমি তো এখনো বেঁচে আছি। স্ত্রী যে সাত মাসের অন্তঃসত্ত্বা, সে কথা মনেই ছিল না।’
পাশে থাকা রোজিনা বেগম বললেন, হাসপাতালে প্রতিদিন অনেকেই দেখতে আসেন। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে যোগ দেওয়া ছেলেরা দেখতে আসেন। খোঁজখবর নেন। তাঁরা রক্ত দিয়েছেন, সহযোগিতা করেছেন। অনেকেই সহযোগিতা করছেন।হাসপাতালের চিকিৎসকেরা সব সময় খোঁজ রাখেন। তাঁরা খুবই আন্তরিক। এখন তিনি প্রতিদিন দুই ঘণ্টার জন্য গৃহকর্মীর কাজে যান। আবার হাসপাতালে ছেলের কাছে ফেরেন। যে বাসায় কাজ করেন, সেই বাসা থেকে ছেলের জন্য প্রতিদিন খাবার দেওয়া হয়। এতে তাঁর ভালো লাগে।
কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক রফিকুল ইসলাম বলেন, ৫ আগস্ট হাসপাতালের জরুরি বিভাগে শতাধিক রোগী এসেছিলেন। এর মধ্যে ছয়জনকে বেশি দিন ভর্তি রাখা হয়। তাঁদের মধ্যে দুজন এখনো হাসপাতালে আছেন। আহাদের অস্ত্রোপচার হয়েছে। তাঁর বিষয়ে খুবই গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। আশা করছেন, খুব কম সময়ের মধ্যে তাঁকে ছাড়পত্র দেওয়া হবে।
ঘটনার দিনের কথা স্মরণ করে রোজিনা বললেন, সেদিন বেলা দেড়টার দিকে ছেলের পায়ে গুলি লাগে। রাত আটটার দিকে ছেলের এক বন্ধু ফোন করে বলেন, আহাদের গুলি লাগছে, হাসপাতালে আসেন। প্রতিবেশী একজনকে সঙ্গে নিয়ে হাসপাতালে ছুটে গিয়ে দেখেন তাঁর ছেলে শুয়ে কাতরাচ্ছেন।
এ ঘটনা বিচার চাইবেন কি না, জানতে চাইলে রোজিনা বললেন, ‘আমরা তো গরিব মানুষ। অনেক কিছু ভয় পাই।’