রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিস্থিতি স্বাভাবিক, তবে সচল হয়নি বিনোদপুর বাজার

শিক্ষার্থীদের পদচারণে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরেছে প্রাণচাঞ্চল্য। আজ বৃহস্পতিবার সকালে
ছবি: প্রথম আলো

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে স্থানীয় লোকজনের সংঘর্ষের ঘটনার পর ধীরে ধীরে বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে শুরু করেছে। গত মঙ্গলবার থেকে বিভিন্ন বিভাগের ক্লাসের পাশাপাশি পরীক্ষাও যথারীতি অনুষ্ঠিত হচ্ছে। আজ বৃহস্পতিবার তুলনামূলকভাবে শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি বেশি দেখা গেছে। তবে সংঘর্ষের পর ষষ্ঠ দিনেও বিনোদপুর বাজার চালু হয়নি।

আজ সকালে সরেজমিন দেখা গেছে, বিনোদপুর বাজারে প্রায় চার শ দোকান আছে। এর মধ্যে বাজারের অলিগলিতে হাতে গোনা দু-একটি দোকান খুলেছে। এর মধ্যে অধিকাংশই সবজি, মাছ ও মুরগির দোকান। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা এখনো ওই বাজারে যাচ্ছেন না। এদিকে বাজারের ওপর দিয়ে চলে যাওয়া ঢাকা-রাজশাহী মহাসড়কে যান চলাচল স্বাভাবিক।

গত শনিবার সন্ধ্যায় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থীর সঙ্গে বাসচালকের তর্কাতর্কির জেরে নগরের বিনোদপুর বাজারে সংঘর্ষের সূত্রপাত। পরে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে স্থানীয় ব্যবসায়ী ও লোকজন এই সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়েন। হামলা-সংঘর্ষ ও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ছোড়া কাঁদানে গ্যাসের শেল এবং রাবার বুলেটে আহত হন দুই শতাধিক শিক্ষার্থী। আহত শিক্ষার্থীদের মধ্যে চারজনকে উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকায় পাঠানো হয়েছে। সংঘর্ষের সময় একটি পুলিশ বক্স ও রাস্তার পাশের অন্তত ৩০টি দোকান পুড়িয়ে দেওয়া হয়। এ ঘটনার পর বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন, পুলিশ ও রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ মামলা করেছে।

ঘটনার দিন শনিবার রাতেই রবি ও সোমবার ক্লাস-পরীক্ষা বন্ধ ঘোষণা করে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। পরে ক্লাস শুরু হয় গত মঙ্গলবার থেকে। এর পর থেকে শিক্ষার্থীরা শ্রেণিকক্ষে ফিরতে শুরু করেছেন। গতকাল বুধবার থেকে বেশ কিছু বিভাগে পরীক্ষাও শুরু হয়েছে। তবে অনেক বিভাগে চলমান পরীক্ষা পিছিয়ে দেওয়া হয়েছে।

ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের ২০২০-২১ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী জাকিরুল ইমাম বলেন, ১৩ মার্চ তাঁদের একটা পরীক্ষা ছিল। বিনোদপুরের ঘটনার পরে ওই পরীক্ষা স্থগিত করা হয়। সেই পরীক্ষা এখন পিছিয়ে দেওয়া হয়েছে।

আরও পড়ুন

ফিন্যান্স বিভাগের ২০২০-২১ শিক্ষাবর্ষের দ্বিতীয় সেমিস্টারের পরীক্ষা চলছে। এই বিভাগের শিক্ষার্থী মোহাম্মদ আদনান আলী বলেন, তাঁদের সর্বশেষ পরীক্ষা হয় ৯ মার্চ। পরের পরীক্ষা ১২ মার্চ ছিল। তবে আগের দিনের ঘটনায় ওই পরীক্ষার নতুন তারিখ ঘোষণা করা হয়েছে ২৭ মার্চ।

বিনোদপুর বাজার সচল হয়নি

ঘটনাস্থল বিনোদপুর বাজারের ঢাকা-রাজশাহী মহাসড়কের দক্ষিণ পাশে বেশ কয়েকজন পুলিশ সদস্য এখনো দাঁড়িয়ে দায়িত্ব পালন করছেন। ওই বাজারের দক্ষিণ সারির প্রায় সব কটি দোকান বন্ধ। তবে আজ সকালে ওই সারির ভেতরের দিকে কয়েকটি দোকান খোলা পাওয়া যায়। সেই দোকানগুলো পুরোপুরি খোলা নয়। তাঁরা দোকানের একটি সাটার খুলে কিছু পণ্য বিক্রি করছেন। বাজারের উত্তর পাশটি বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। পুড়ে যাওয়া ও ভেঙে যাওয়া দোকানপাট এখনো ঠিক করা হয়নি।

উত্তর পাশে মো. বাদশাহ ও আলাউদ্দিন নামের দুই ব্যক্তি একটা খাঁচায় কিছু মুরগি নিয়ে বসে ছিলেন। বাদশাহ বলেন, সকাল থেকে সাড়ে ৯টা পর্যন্ত সাত-আটটি মুরগি বিক্রি করতে পেরেছেন। এর মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো শিক্ষার্থী আসেননি। যাঁরা কিনেছেন তাঁরা সবাই বিনোদপুর এলাকার বাসিন্দা।

বিনোদপুর বাজারের হাতে গোনা দু-একটি দোকান ছাড়া প্রায় সব দোকানই এখনো বন্ধ
ছবি: প্রথম আলো

ওই বাজারের উত্তর পাশে একেবারে পশ্চিমে সবজি ও মাছের বাজার। সেখানে আজ বেশ কয়েকটি দোকান খুলেছে। মাছের বাজারও বসেছে। তবে সবজির পরিমাণ বেশি হলেও মাছ সরবরাহ একেবারে কম। বাজারে ভ্যানের ওপর সবজি বিক্রি করেন শহিদুল ইসলাম। তিনি গতকালও বাজারে সবজি নিয়ে এসেছিলেন। তিনি বলেন, ‘ক্রেতা কম। ছেলেপেলে (শিক্ষার্থী) না এলে কী আর বিক্রি হবে!’
সবজির দোকানের পাশে মাছ নিয়ে বসেছেন কামরুজ্জামান। তিনি বলেন, মাছ কম নিয়ে এসেছেন। বাজারে যাঁরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন, তাঁরা দোকান চালাতে নিষেধ করছেন। তাঁরা বলছেন, ক্ষতিপূরণ আদায় না হলে দোকান খোলা যাবে না।

শিক্ষার্থীরা বিনোদপুর বাজারে যাচ্ছেন না

বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৭টি হলের মধ্যে বেশির ভাগ শিক্ষার্থী বিনোদপুরে কেনাকাটা করে থাকেন। তবে সংঘর্ষের দিন থেকে তাঁরা বিনোদপুরে যাচ্ছেন না। অনেকেই বিনোদপুর বাজারকে বয়কটের ঘোষণা দিয়েছেন। তাঁরা কেনাকাটার জন্য বেছে নিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতরের স্টেশন বাজার।

আরও পড়ুন

বিশ্ববিদ্যালয়ের শাহমখদুম হলের শিক্ষার্থী মো. সুজন মিয়া বিনোদপুরে বাজার করতেন। এখন বিকল্প হিসেবে তিনি স্টেশন বাজারে যান। তিনি বলেন, তাঁর ভাইদের ওপর যে হামলা হয়েছে, তা ভুলে গেলে চলবে না। এই ক্ষত সহজে মুছে যাবে না। তাঁরা অন্যায় করেছেন, সেটার জন্য শাস্তি পেতেই হবে।
বিনোদপুর বাজার সমিতির সভাপতি শহিদুল ইসলাম বলেন, শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আগের সম্পর্ক ফিরে আসুক, এটা তাঁরাও চান। এ জন্য তাঁরা আলোচনা চালানোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। আলোচনাই একমাত্র সমাধান বলে তিনি মনে করেন।

বিশ্ববিদ্যালয়ের সহ-উপাচার্য মো. সুলতান-উল-ইসলাম বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিস্থিতি এখন স্বাভাবিক। ক্লাসের পাশাপাশি পরীক্ষাও চলছে। শিক্ষার্থীরা একাডেমিক কাজে মন দিচ্ছেন। পাশাপাশি দাপ্তরিক কাজও চলছে। বিনোদপুর বাজারের ব্যবসায়ীদের সঙ্গে সম্পর্কের উন্নয়নের বিষয়ে তিনি বলেন, এ বিষয়ে স্থানীয় মেস মালিকদের সঙ্গে বসেছেন তাঁরা। সেখানে শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা নিয়ে কথা হয়েছে। তাঁরা শিক্ষার্থীদের সঙ্গে ভালো আচরণের নিশ্চয়তা দিয়েছেন। সম্পর্ক উন্নয়নের বিষয়ে বিনোদপুরের ব্যবসায়ীদের সঙ্গেও আলোচনায় বসার কথা আছে। দ্রুতই এ সমস্যার সমাধান হবে বলে আশা করছেন তিনি।

মুরগি নিয়ে ক্রেতার অপেক্ষায় বসে আছেন দুই বিক্রেতা
ছবি: প্রথম আলো