রাজশাহীতে ‘পুকুরে’ আওয়ামী লীগ নেতার বাড়ি
রাজশাহী নগরের শাহ্ মখদুম থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক কাউন্সিলর শাহাদত আলী (শাহু) জালিয়াতি করে জমির ‘পুকুর শ্রেণি’ পরিবর্তন করে ‘ধানি শ্রেণি’ করেছিলেন। পরে সেই পুকুর ভরাট করে প্লট আকারে বিক্রি করেন। ইতিমধ্যে প্লটগুলোতে ভবন নির্মাণ শুরু হয়েছে। এরই মধ্যে জমির শ্রেণি পরিবর্তনের জালিয়াতি ধরা পড়ার পরে জেলা প্রশাসন খতিয়ান সংশোধন করে আবার ‘পুকুর’ শ্রেণিতে রূপান্তর করে দিয়েছে। ফলে ৫৭টি প্লট কাগজ-কলমে এখন হয়ে গেল ‘পুকুর’।
সাধারণত ভূমির শ্রেণি পরিবর্তনের জন্য জেলা প্রশাসকের কাছে আবেদন করতে হয়। প্রয়োজনীয় তদন্তের পর জেলা প্রশাসক সংশ্লিষ্ট এলাকার সহকারী কমিশনারকে (ভূমি) নির্দেশ দেন। এরপর যাচাই-বাছাই শেষে ভূমির শ্রেণি পরিবর্তন করা হয়। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এ ক্ষেত্রে সেই ধরনের কোনো আবেদনই জেলা প্রশাসনের কাছে করা হয়নি। জেলা প্রশাসকও কোনো দাপ্তরিক আদেশ দেননি। কিন্তু নগরের ৮২ বড়বনগ্রাম মৌজার আরএস ১২৬ খতিয়ানের ২০২৪ দাগের পুকুর শ্রেণির জমিটি জালিয়াতি করে ‘ধানি শ্রেণি’ করা হয়েছে।
নগরের বোয়ালিয়া ভূমি অফিস সূত্রে জানা যায়, আরএস ১২৬ খতিয়ানের ২০২৪ দাগের পুকুরটি আবদুল খালেক, ওসমান আলী, ছোলেমান ও এমদাদ নামে আরএস রেকর্ড প্রচলিত ছিল। ২০১৯ সালের ৩ ফেব্রুয়ারি ৬৪৩ নম্বর দলিল মূলে ২০২২ সালের ৩১ মার্চ ৫৭৯৪/৯-১/২১-২২ নম্বর নামজারি কেসে ২০২৪ দাগের ১ একর ১৪৭৪ শতাংশ পুকুরটি শাহাদত আলী দিং-এর নামে নামজারি হয়। যার প্রস্তাবিত খতিয়ান নম্বর ১৯৯৮৭ এবং হোল্ডিং নম্বর ১৭৯৫৬। পরে এই খতিয়ান থেকে প্লট আকারে চড়া দামে বিক্রি করা হয়। যাঁরা এই প্লট কিনেছেন, তাঁরা ধানি জমি হিসেবেই কিনেছেন।বড়বনগ্রাম মৌজার ২০২৪ দাগের পুকুরটি ক্রয়ের সময়েই জালিয়াতির আশ্রয় নিয়ে দলিল করা হয়েছে। জাল খতিয়ান ব্যবহার করা হয়েছে। যাতে জমির শ্রেণি ‘ধানি’ দেখানো হয়েছে। নামজারির সময় শাহাদত আলীর নামে ধানি হিসেবেই প্রস্তাবিত খতিয়ানে উল্লেখ করা হয়েছে।
জালিয়াতির বিষয়টি টের পান বোয়ালিয়ার সহকারী কমিশনার (ভূমি) অভিজিত সরকার। তিনি শাহাদত আলীর বিক্রি করা ৫৭টি প্লটের সন্ধান পান। গত ৮ অক্টোবর অভিজিত সরকার এক চিঠিতে ‘নামজারি কেসগুলো বাতিল/সংশোধন’-এর জন্য জেলা প্রশাসকের কাছে প্রতিবেদন পাঠান। ওই দিনই প্লটগুলো আগের হোল্ডিংয়ে ফেরত পাঠিয়ে সংশোধন করা হয়। এখন ৫৭টি প্লটের শ্রেণি ‘পুকুর’।
শাহাদত আলীর মোট সম্পদের মধ্যে ৭ কোটি ২৮ লাখ ৫১ হাজার ৫০৩ টাকার সম্পদই আয়ের সঙ্গে অসংগতিপূর্ণ। আর তাঁর স্ত্রীর আয়ের সঙ্গে অসংগতিপূর্ণ সম্পদ আছে ১ কোটি ৬ লাখ ৬ হাজার ৯২৬ টাকার।
ইতিমধ্যে ওই জমিতে পুকুর ভরাট করে বাড়িঘর নির্মাণ শুরু হয়ে গেছে। কয়েক দিন আগে সেখানে গিয়ে দেখা যায়, ওই জমিতে ৯টি বাড়ির নির্মাণ কাজ চলছে। তবে জায়গাটি যে পুকুর ছিল, তা এখনো বোঝা যাচ্ছে। নির্মাণাধীন বাড়িঘর সব জলমগ্ন হয়ে আছে। সেখানে প্লটের মালিকদের একজনকে পাওয়া গেল। তাঁর নাম টিপু সুলতান। তিনি একজন ব্যাংক কর্মকর্তা। ২০২২ সালে আড়াই কাঠা জমি কিনেছেন। টিপু সুলতান বলেন, শাহাদত আলীর কাছ থেকে তিনি এই জমি কিনেছেন। ভরাট করার পরে সরেজমিন দেখেই তিনি কিনেছেন। এখন বাড়ির নির্মাণ কাজ শুরু করেছেন। একতলা পর্যন্ত উঠেছে। কাগজপত্রে যে এই জমির শ্রেণি পুকুর ছিল, তা তিনি জানেন না এবং ভূমি অফিস থেকেও এখনো তাঁদের কিছু জানানো হয়নি।
রাজশাহী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (আরডিএ) কর্মকর্তা আবুল কালাম আজাদ জানিয়েছেন, ভূমি অফিস থেকে খতিয়ান সংশোধনের এমন কোনো কাগজ তাঁরা এখনো পাননি। পেলে সেই অনুযায়ী আইনি ব্যবস্থা নেবেন। যাঁরা এখনো বাড়ি শুরু করেননি। তাঁদের আর অনুমতি দেওয়া হবে না।
শাহাদত আলীর কাছ থেকে তিনি এই জমি কিনেছেন। ভরাট করার পরে সরেজমিন দেখেই তিনি কিনেছেন। এখন বাড়ির নির্মাণ কাজ শুরু করেছেন। একতলা পর্যন্ত উঠেছে। কাগজপত্রে যে এই জমির শ্রেণি পুকুর ছিল, তা তিনি জানেন না এবং ভূমি অফিস থেকেও এখনো তাঁদের কিছু জানানো হয়নি।
গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর থেকে অভিযুক্ত শাহাদত আলী পলাতক আছেন। এ জন্য এসব অভিযোগের বিষয়ে তাঁর সঙ্গে কথা বলা সম্ভব হয়নি। সহকারী কমিশনার (ভূমি) অভিজিত সরকার প্রথম আলোকে বলেন, জমির দলিল করার সময়ই ভুয়া খতিয়ান ব্যবহার করা হয়েছে। এ জন্য দলিলে জমির শ্রেণি ধানি হিসেবেই পাওয়া গেছে। তবে নামজারির সময় সার্ভেয়ারের সরেজমিন করার দরকার ছিল। এটি করলে তখনই জালিয়াতির বিষয়টি ধরা পড়ত। বিষয়টি তিনি খতিয়ে দেখবেন।
শাহাদত আলীর বিরুদ্ধে আগে থেকে বিরোধপূর্ণ জমি কিনে দখলে নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। অবৈধভাবে সম্পদ অর্জনের অভিযোগে দুদকে শাহাদত আলী ও তাঁর স্ত্রী নাজমা আলীর বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। এতে শাহাদত আলীর মোট সম্পদের মধ্যে ৭ কোটি ২৮ লাখ ৫১ হাজার ৫০৩ টাকার সম্পদই আয়ের সঙ্গে অসংগতিপূর্ণ। আর তাঁর স্ত্রীর আয়ের সঙ্গে অসংগতিপূর্ণ সম্পদ আছে ১ কোটি ৬ লাখ ৬ হাজার ৯২৬ টাকার। গত বছর ৩১ ডিসেম্বর দুদকের সমন্বিত রাজশাহী জেলা কার্যালয়ে দুজনের বিরুদ্ধে আলাদা দুটি মামলা করা হয়।