ছাত্রদল ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্রদের সংঘর্ষে আহত শতাধিক

খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও ছাত্রদলের সংঘর্ষে আহত টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র নিলয় আহমেদকে হাসপাতালে নিয়ে এসেছেন তাঁর সহপাঠীরা। মঙ্গলবার বিকেলে খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালেছবি: সাদ্দাম হোসেন

ছাত্ররাজনীতি বন্ধের দাবিকে কেন্দ্র করে খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (কুয়েট) ছাত্রদল ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতা–কর্মীদের মধ্যে দফায় দফায় সংঘর্ষ এবং পাল্টাপাল্টি ধাওয়ার ঘটনা ঘটেছে। মঙ্গলবার দুপুর থেকে বিকেল পর্যন্ত থেমে থেমে সংঘর্ষ চলে। এতে শতাধিক আহত হন।

রাতে শিক্ষার্থীরা প্রেস ব্রিফিং করে কুয়েটে ছাত্ররাজনীতি পুরোপুরি নিষিদ্ধ, শিক্ষার্থীদের ওপর হামলাকারীদের শাস্তি এবং উপাচার্য, উপ-উপাচার্য, ছাত্রকল্যাণ পরিচালকের পদত্যাগসহ পাঁচ দফা দাবি জানিয়েছেন। বুধবার বেলা একটার মধ্যে দাবি পূরণের আলটিমেটাম দিয়েছেন তাঁরা। দাবি পূরণ না হওয়া পর্যন্ত কুয়েটে সব ধরনের ক্লাস-পরীক্ষা বন্ধ থাকবে বলে জানিয়েছেন শিক্ষার্থীরা।

এদিকে কুয়েটে সংঘর্ষের জেরে রাতে খুলনা নগরের শিববাড়ী মোড়ে উত্তেজনা দেখা দেয়। রাত সাড়ে আটটার দিকে জিয়া হল চত্বরের মধ্যে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতা–কর্মীরা অবস্থান নেন এবং মিছিল করেন। আর বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনের নেতা–কর্মীরা অবস্থান নেন জিয়া হল চত্বরের পাশেই শিববাড়ী মোড় চত্বরে। দুই দলের মধ্যে দূরত্ব ছিল মাত্র কয়েক হাত। এ সময় দুই পক্ষের মধ্যে উত্তেজনা বিরাজ করছিল।

পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে কুয়েটে দুই প্লাটুন বিজিবি মোতায়েন করা হয়েছে। কুয়েটে শিক্ষার্থীদের ওপর ছাত্রদলের হামলার নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়েছে জাতীয় নাগরিক কমিটি। কুয়েটে সংঘর্ষের পর রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পৃথক বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করেছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও ছাত্রদল।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন কুয়েট শাখার সদস্যসচিব জাহিদুর রহমান বলেন, তাঁদের পক্ষের অন্তত ৫০ শিক্ষার্থী গুরুতর আহত হয়েছেন। এ ছাড়া আহতের সংখ্যা দেড় শতাধিক হবে।

কুয়েট ক্যাম্পাস থেকে শুরু হওয়া সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়ে আশপাশের এলাকাতেও
ছবি: সংগৃহীত

সংঘর্ষের পর ঘটনাস্থল থেকে পাঁচজনকে আটক করা হয়েছে জানিয়ে খুলনার খানজাহান আলী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. কবির হোসেন বলেন, সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী, পুলিশ ও র‍্যাব পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে কাজ করছে।

কুয়েট ক্যাম্পাস সূত্র জানায়, গত ১১ আগস্ট সিন্ডিকেট সভায় বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের রাজনীতি নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়।

প্রত্যক্ষদর্শী সূত্রে জানা যায়, কয়েক দিন ধরে কুয়েটে শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন মেসেঞ্জার গ্রুপে ছাত্রদলের কমিটি গঠন নিয়ে নানা প্রতিক্রিয়া চলছিল। সোমবার তাঁরা ক্যাম্পাস এলাকায় লিফলেট বিতরণ করে। মঙ্গলবার সকালে ছাত্ররাজনীতি বন্ধের দাবিতে শিক্ষার্থীরা মিছিল বের করেন। পরে উপাচার্যের কার্যালয় ঘেরাও করলে ছাত্রদল নেতা–কর্মীদের সঙ্গে বাগ্‌বিতণ্ডায় জড়ান তাঁরা। দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও শিক্ষার্থীরা ক্যাম্পাসে মিছিল বের করেন। তাঁরা ‘ছাত্ররাজনীতি ঠিকানা, এই কুয়েটে হবে না’, ‘দাবি মোদের একটাই, রাজনীতিমুক্ত ক্যাম্পাস চাই’, ‘এই ক্যাম্পাসে হবে না, ছাত্ররাজনীতির ঠিকানা’সহ বিভিন্ন স্লোগান দিতে দিতে আবাসিক হলগুলো প্রদক্ষিণ করেন। পরে কেন্দ্রীয় জামে মসজিদের সামনে পৌঁছালে ছাত্রদলের নেতা–কর্মীরা তাঁদের ‘ভুয়া ভুয়া’ বলে স্লোগান দেন। এ সময় দুই পক্ষের মধ্যে উত্তেজনা দেখা দেয়। শুরু হয় পাল্টাপাল্টি ধাওয়া। একপর্যায়ে তা কুয়েট ক্যাম্পাসের বাইরেও ছড়িয়ে পড়ে। কুয়েট এলাকার রেলগেট, তেলিগাতিসহ আশপাশের এলাকার বিএনপির নেতা-কর্মীরা ছাত্রদলের সঙ্গে যোগ দিলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত সংঘর্ষ চলে। এতে শতাধিক আহত হন।

দফায় দফায় সংঘর্ষ চলাকালে কুয়েট ফটকের সামনের চিত্র। মঙ্গলবার বিকেলে
ছবি: প্রথম আলো

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের একজন নেতা প্রথম আলোকে বলেন, ‘সোমবার একদল শিক্ষার্থী ক্যাম্পাসের বাইরে ছাত্রদলের ফরম বিতরণ করেছেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে আমরা সাধারণ শিক্ষার্থীরা আজ (মঙ্গলবার) সমাবেশ ডেকেছিলাম। আমরা উপাচার্যের কাছে একটি আবেদন করার কথা ভেবেছিলাম। আমরা যখন উপাচার্যের কাছে যাচ্ছিলাম, তখন কুয়েট ছাত্রদলের সঙ্গে জড়িত কয়েকজন বাইরে থেকে আরও ১৫–২০ জনকে নিয়ে আসেন। তাঁরা আমাদের কটূক্তি করতে থাকেন এবং আমাদের কয়েকজনকে আক্রমণ করেন।’

ওই নেতা আরও বলেন, ‘বাইরে থেকে ছাত্রদলের ছেলেরা, স্থানীয় লোকজন ও হেলমেট পরা আরও অনেকে আমাদের ওপর তখন ইটপাটকেল ছোড়ে এবং রামদাসহ বিভিন্ন অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে আক্রমণ করতে আসে।’

আরও পড়ুন

ছাত্রদলের এক নেতা প্রথম আলোকে বলেন, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মধ্যে ছাত্রশিবিরের অংশ এবং পতিত সরকারের ছাত্রসংগঠনের পক্ষের দু-একজন মিলে ক্যাম্পাস থেকে এবং ক্যাম্পাসের আশপাশে ছাত্রদলের রাজনীতি বাধাগ্রস্ত করতে চায়। এর পরিপ্রেক্ষিতেই সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে।

খুলনা মহানগর ছাত্রদলের সদ্য সাবেক সদস্যসচিব তাজিম বিশ্বাস প্রথম আলোকে বলেন, ছাত্রশিবির ও নিষিদ্ধঘোষিত ছাত্রলীগের যেসব নেতা–কর্মী এখনো আছেন, তাঁরাই মূলত ছাত্রদলের নেতা–কর্মীদের ওপর প্রথমে হামলা করেছেন।

কুয়েটের ঘটনার সঙ্গে ছাত্রশিবিরের কোনো সম্পর্ক নেই দাবি করে খুলনা মহানগর ছাত্রশিবিরের সভাপতি আরাফাত হোসাইন গণমাধ্যমকে বলেন, সাধারণ শিক্ষার্থীদের ওপর ছাত্রদল ও বিএনপির নেতা–কর্মীরা হামলা চালিয়ে অনেককে আহত করেছেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিক্ষোভ

কুয়েটে সংঘর্ষের পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পৃথকভাবে বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করেছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও ছাত্রদল। রাত নয়টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজু ভাস্কর্য এলাকায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কর্মসূচি পালন করে। একই সময় রাজু ভাস্কর্য থেকে খানিকটা দূরে ডাস ক্যাফেটেরিয়া এলাকায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদলের নেতা–কর্মীরা বিক্ষোভ করেন।

‘কুয়েটের শিক্ষার্থীদের ওপর ছাত্রদলের সন্ত্রাসী হামলার প্রতিবাদে’ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে বিক্ষোভ করে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। মঙ্গলবার রাতে টিএসসি এলাকা
ছবি: প্রথম আলো

হামলার ঘটনায় নিন্দা জানিয়ে বিক্ষোভ সমাবেশ করেছেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) একদল শিক্ষার্থী। তাঁরা হামলায় জড়িতদের আইনের আওতায় আনার দাবি জানান।

কুয়েটে ছাত্রদলের নেতা-কর্মীদের ওপর ‘সন্ত্রাসী হামলার’ প্রতিবাদে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিক্ষোভ সমাবেশ করে ছাত্রদল। মঙ্গলবার রাতে টিএসসি এলাকায়
ছবি: প্রথম আলো

এদিকে কুয়েটের ‘সাধারণ শিক্ষার্থীদের ওপর ছাত্রদল নেতা-কর্মীদের হামলার’ প্রতিবাদে বিভিন্ন স্থানে বিক্ষোভ করেছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। রাতে কুষ্টিয়া, কুড়িগ্রাম, বরিশাল, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় বিক্ষোভ মিছিল থেকে হামলায় জড়িতদের বিচারের দাবি জানানো হয়।