মেয়েকে শ্বশুরবাড়ি থেকে আনতে গিয়ে আনন্দ নিমেষেই পরিণত হলো বিষাদে
মাদ্রাসাশিক্ষক আনোয়ার হোসেন কখনো কাঁদছেন, আবার কান্না থামিয়ে স্বজনদের চিকিৎসার জন্য দৌড়াচ্ছেন। তিনি কী করবেন, কিছু ভেবে পাচ্ছেন না। ঝালকাঠির গাবখান সেতুর টোল প্লাজায় সড়ক দুর্ঘটনায় তাঁর চারজন স্বজন মারা গেছেন। ছয়জন হাসপাতালে কাতরাচ্ছেন। তাঁদের দুজনের অবস্থাও আশঙ্কাজনক। আজ বুধবার বিকেলে বরিশালের শের-ই-বাংলা মেডিকেলে কলেজ হাসপাতালের সার্জারি ইউনিটে লোকজনের ভিড়ের মধ্যে দৌড়ঝাঁপ করছিলেন তিনি।
আনোয়ার হোসেন ঝালকাঠি সদরের গাবখান ইউনিয়নের ওস্তা খান গ্রামের বাসিন্দা। তাঁর মেয়ের বিয়ে হয়েছে মাস ছয়েক আগে। ১৫ এপ্রিল মেয়েকে পিরোজপুরের স্বরূপকাঠি উপজেলার সাগরকান্দা গ্রামে শ্বশুরবাড়িতে তুলে দিয়েছেন। আজ দুপুরে ২৮ স্বজনকে নিয়ে চারটি ইজিবাইকে (ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা) করে মেয়েকে শ্বশুরবাড়ি থেকে আনতে যাচ্ছিলেন। বেলা পৌনে একটার দিকে গাবখান থেকে স্বজনদের নিয়ে রওনা হয়েছিলেন। গাবখান সেতুর টোল প্লাজায় এসে তাঁদের বহনকারী চারটি ইজিবাইকের দুটি আটকা পড়ে যানজটে। অপর দুটি ইজিবাইক টোল দিয়ে ২০০ ফুট দূরত্বে সড়কের পাশে অপেক্ষমাণ ছিল। আনোয়ার হোসেনও ছিলেন সামনের দুই ইজিবাইকের একটিতে। দুটি ইজিবাইক দুর্ঘটনায় দুমড়েমুচড়ে গেলেও দুটি ইজিবাইক রক্ষা পেয়েছে। আর এতেই ভাগ্যক্রমে প্রাণে বেঁচে যান আনোয়ার।
আনোয়ার হোসেন প্রথম আলোকে ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেন, ‘মনে হচ্ছিল ভূমিকম্প হচ্ছে। একটা ট্রাক পশ্চিম প্রান্ত দিয়ে দ্রুতগতিতে দানবের মতো টোল প্লাজায় টোল দিতে অপেক্ষমাণ গাড়িগুলোতে একের পর এক চাপা দিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে আসছিল। আর এসব গাড়ির মধ্যে থাকা যাত্রীদের কান্না-আহাজারিতে পুরো এলাকা কাঁপছিল। দুই থেকে তিন মিনিটের এই তাণ্ডবের পর ট্রাকটি উল্টে রাস্তার পাশে পড়ে যায়। তখন রাস্তার ওপরে মৃত মানুষ, রক্ত আর আহতদের আহাজারি...।’
আনোয়ার হোসেন এসব বলতে বলতে হাউমাউ করে কেঁদে ফেলেন। আহাজারি করে বলছিলেন, ‘চোখের পলকে সব আনন্দ বিষাদে পরিণত হয়ে গেল। কে বুঝছিল মরণ আমাদের ডাকছে...।’
সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত বরিশালের শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে গুরুতর আহত ১২ জনকে আনা হয়। তাঁদের মধ্যে দুজন মারা গেছেন, একজনকে উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকায় পাঠানো হয়েছে। তখনো ৯ জন চিকিৎসাধীন ছিলেন। তাঁদের অধিকাংশের অবস্থাই আশঙ্কাজনক।
হাসপাতালের পরিচালক এইচ এম সাইফুল ইসলাম এসব তথ্য নিশ্চিত করে প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা আহত ব্যক্তিদের সাধ্যমতো চিকিৎসা দেওয়ার চেষ্টা করছি। এখনো বেশ কয়েকজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক।’
ঝালকাঠির কাঁঠালিয়া উপজেলার শৌজলিয়া এলাকার ইব্রাহিম হোসেনের (৪০) অবস্থা আশঙ্কাজনক। তাঁর মাথা, চোখ, পা গুরুতর আঘাতপ্রাপ্ত। সংবিৎ নেই। তাঁর শয্যার একটু দূরেই থাকা মা শেফালি বেগমের (৬০) অবস্থাও গুরুতর। তাঁর স্ত্রী তাহমিনা আক্তার (৩৫), একমাত্র মেয়ে নূর জাহানের (৪ বছর) লাশ হাসপাতালে। ইব্রাহিমের চাচি রিনা বেগম পাশে বসে কেবল কাঁদছিলেন।
রিনা বেগম জানান, ইব্রাহিম ঢাকার একটি বায়িং হাউসে চাকরি করেন। ঈদের ছুটিতে বাড়িতে এসেছিলেন। স্ত্রী, সন্তান ও মাকে নিয়ে বুধবার ঢাকায় ফিরছিলেন। বাড়ি থেকে একটি ইজিবাইকে ঝালকাঠিতে এসে তাঁদের ঢাকার বাস ধরার কথা ছিল। কিন্তু পথে ট্রাকচাপায় সব শেষ।
ইজিবাইকচালক রিয়াজুল (৩০) প্রাণে বাঁচলেও তাঁর গাড়ির চারজন যাত্রীর দুজন ঘটনাস্থলে মারা গেছেন। রিয়াজুলের অবস্থা গুরুতর। যন্ত্রণায় কাতরাতে কাতরাতে রিয়াজুল বলেন, ‘কেয়ামতের কথা হুনছি, আইজ দেখলাম। মুই টোলের টাকা দেতে আলহাম। এইর মধ্যে একটা ট্রাক আইয়্যা এমন ধাক্কা দেছে, আমি ছিইট্টা ৫০ হাত দূরে পড়ছি। কেমন যে লাগছে, কইতে পারমু না। মনে অইছিল, কেয়ামত অইতে আছে। মোর গাড়ির দুইজন যাত্রী নাই। বাকি দুইজনের অবস্থাও খারাপ। মোরে বাঁচান...।’ পরে তাঁকে উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকায় নেওয়া হয়েছে।
ঝালকাঠির গাবখান সেতুর টোল প্লাজায় আজ সিমেন্টবাহী একটি ট্রাকের চালক নিয়ন্ত্রণ হারালে সেটি চারটি ইজিবাইক, একটি প্রাইভেট কারসহ বেশ কয়েকটি গাড়িকে ধাক্কা দিয়ে রাস্তার পাশে চলে যায়। এ সময় ট্রাকটির নিচে চাপা পড়া প্রাইভেট কার থেকে শিশুসহ সাতজনের লাশ উদ্ধার করা হয়। এ ছাড়া ট্রাকের ধাক্কায় ঘটনাস্থলেই নিহত হয়েছেন ইজিবাইকের চার যাত্রী। পরে হাসপাতালে আরও তিনজন মারা যান। এ ঘটনায় এখন পর্যন্ত ১৪ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। এর মধ্যে ১২ জনের লাশ ঝালকাঠি সদর হাসপাতালে এবং দুজনের লাশ বরিশালের শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজের মর্গে আছে। ঝালকাঠির পুলিশ সুপার (এসপি) মোহাম্মদ আফরুজুল হক বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
এ ঘটনায় শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ৯ জন, ঢাকায় ১ জন, ঝালকাঠি সদর হাসপাতালের ৩ জনসহ মোট ১৩ চিকিৎসাধীন।
ঝালকাঠির পুলিশ সুপার মোহাম্মদ আফরুজুল হক বলেন, পুলিশ ট্রাকের চালক ও তাঁর সহকারীকে আটক করেছে। তাঁরা হলেন ট্রাকের চালক আল আমিন ও তাঁর সহকারী নাজমুল শেখ।
প্রত্যক্ষদর্শী ব্যক্তি ও পুলিশ জানায়, টোল প্লাজায় টাকা দেওয়ার অপেক্ষায় ছিল চারটি ইজিবাইক, একটি পণ্যবাহী ছোট ট্রাক, একটি প্রাইভেট কারসহ বেশ কয়েকটি গাড়ি। এ সময় খুলনা থেকে ছেড়ে আসা সিমেন্টবাহী ট্রাকটি সেতুর দক্ষিণ দিক থেকে প্রচণ্ড গতিতে টোল প্লাজার সামনে থাকা সব গাড়িকে ধাক্কা দিয়ে প্রতিবন্ধক ভেঙে রাস্তার পশ্চিম পাশে খাদে পড়ে যায়। এতে এই হতাহতের ঘটনা ঘটে। এ সময় প্রাইভেট কারটি ট্রাকের নিচে চাপা পড়ে।
দুর্ঘটনাটিতে নিহত ব্যক্তিরা হলেন সদর উপজেলার গাবখান গ্রামের সেলিম হাওলাদারের ছেলে মো. নজরুল (৩৫), ওস্তা খান গ্রামের মান্নান মাঝির ছেলে শফিকুল মাঝি (৫০), সদর উপজেলার সেকেরহাটের নোয়াপাড়া গ্রামের আ. হাকিমের ছেলে আতিকুল রহমান সাদি (১৪), বিমানবাহিনীর সদস্য নুরুল ইসলামের ছেলে ইমরান হোসেন (৪০), কাঁঠালিয়া উপজেলার তালগাছিয়া গ্রামের ইব্রাহিমের মেয়ে নুরজাহান (৭), প্রাইভেট কারের চালক রাজাপুরের ইব্রাহিম (৪০), কাঁঠালিয়ার তালগাছিয়া গ্রামের ইব্রাহিমের স্ত্রী তহমিনা (২৫), রাজাপুরের উত্তর সাউথপুরের মিজানুর রহমানের ছেলে হাসিবুর রহমান (৪০), হাফিজুর রহমানের স্ত্রী সোনিয়া বেগম (৩০), বারেকের মেয়ে নিপা (২২), রাজাপুর হাসিবুর রহমানের মেয়ে তানিয়া আক্তার (৩), তাহমিদ রহমান (১), স্বরূপকাঠির রুহুল আমিন ও ঝালকাঠি পৌরসভার পারকিফাইত নগরের ভিক্ষুক শহিদুল ইসলাম।