সমস্যার সমাধানে দুই পক্ষকে ছাড় দিতে হবে : আরআরআরসি

মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের মংডু মডেল ভিলেজ পরিদর্শন করেন বাংলাদেশ থেকে যাওয়া শরণার্থী, ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মিজানুর রহমান ও রোহিঙ্গা প্রতিনিধি দলের সদস্যরা
ছবি: সংগৃহীত

প্রত্যাবাসনের জন্য মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে সহায়ক পরিবেশ ও পরিস্থিতি আছে কি না, তা যাচাই করতে গিয়েছিলেন কক্সবাজারের টেকনাফের আশ্রয়শিবিরে থাকা ২০ জনের রোহিঙ্গা প্রতিনিধিদল। শুক্রবার সকাল সাড়ে ১০টা থেকে বেলা ৩টা পর্যন্ত প্রতিনিধিদলের সদস্যরা মংডু শহরের আশপাশের অন্তত ১৫টি গ্রাম ঘুরে দেখেন।

রোহিঙ্গা প্রতিনিধিদলের সদস্যরা সেখানের পরিস্থিতি দেখে সন্ধ্যা পৌনে ছয়টার দিকে টেকনাফ পৌঁছে অসন্তোষ প্রকাশ করেন। এ বিষয়ে তাঁরা সাংবাদিকদের বলেন, রাখাইনে প্রত্যাবাসন উপযোগী পরিবেশ এবং পরিস্থিতি কোনোটাই নেই। ছয় বছর আগে ফেলে আসা তাঁদের (রোহিঙ্গাদের) জন্মভূমিতে গড়ে তোলা হয়েছে সেনা ব্যারাক, পুলিশ ফাঁড়ি, সীমান্তচৌকিসহ নানা অবকাঠামো। এখন রোহিঙ্গাদের মংডুর যে জায়গায় পুনর্বাসনের জন্য ‘মডেল ভিলেজ’ নির্মাণ করা হচ্ছে, তাতে থাকতে রাজি হবে না রোহিঙ্গারা। জন্মভূমিতে পুনর্বাসনের নিশ্চয়তা না পেলে কক্সবাজারের আশ্রয়শিবিরে থাকা কোনো রোহিঙ্গা রাখাইনে ফিরতে রাজি হবে না।

রোহিঙ্গা প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব দেন শরণার্থী, ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার (আরআরআরসি) দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব মোহাম্মদ মিজানুর রহমান। রোহিঙ্গা প্রতিনিধিদলের সহযোগিতার জন্য ছিলেন বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি), বাংলাদেশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও সরকারি একাধিক সংস্থার আরও সাতজন সদস্য।

সকাল সাড়ে নয়টার দিকে টেকনাফ পৌরসভার চৌধুরীপাড়ার নাফ নদীর জেটি দিয়ে রোহিঙ্গা প্রতিনিধিদলের সদস্যরা রাখাইন রাজ্যে যান। মাত্র ৪৫ মিনিটের মাথায় পাঁচ কিলোমিটার প্রস্থের নাফ নদী অতিক্রম করে দলের সদস্যরা মংডুর নাকফুরা খালের জেটিতে পৌঁছান। সেখান থেকে রোহিঙ্গা প্রতিনিধিদলের সদস্যদের বিভিন্ন গ্রাম ও প্রত্যাবাসনের জন্য নির্মিত অবকাঠামো দেখানো হয়।

সন্ধ্যা পৌনে ছয়টার দিকে মংডু থেকে নাফ নদী অতিক্রম করে রোহিঙ্গা প্রতিনিধিদলটি টেকনাফের চৌধুরীপাড়ার জেটিতে পৌঁছায়। রাখাইন রাজ্য পরিদর্শন নিয়ে জেটিতে অপেক্ষায় সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন আরআরআরসি মোহাম্মদ মিজানুর রহমান।

তিনি বলেন, ‘রোহিঙ্গা প্রতিনিধিদলকে রাখাইনের বেশ কিছু গ্রাম, পুনর্বাসনকেন্দ্র, ট্রানজিট কেন্দ্রসহ নানা অবকাঠামো দেখানো হয়েছে। মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ আমাদের মংডু শহরও দেখিয়েছেন। মংডু শহরে প্রচুর রোহিঙ্গা আছে। তাঁরা (রোহিঙ্গারা) সেখানে ব্যবসা–বাণিজ্য করছেন। যতটুকু জেনেছি, সেখানে (মংডুতে) ৮০ শতাংশ রোহিঙ্গা মুসলমান থাকেন। এসব দেখে রোহিঙ্গা প্রতিনিধিদল বলতে পারবেন, তাঁরা পরিস্থিতি দেখে সন্তুষ্ট কি না।’

জন্মভূমিতে পুনর্বাসন করা না হলে রোহিঙ্গারা রাখাইনে ফিরবেন না, রোহিঙ্গা প্রতিনিধিদলের কয়েকজন সদস্যদের এমন মন্তব্য প্রসঙ্গে আরআরআরসি মিজানুর রহমান বলেন, ‘এ রকম কথা বললে সমস্যার সমাধান হবে না। দুই পক্ষকে ছাড় দিতে হবে। সন্তুষ্টির বিষয়টা আপেক্ষিক। যে সমস্যা ৬০-৭০ বছর ধরে সমাধান হচ্ছে না, তা এক-দুই দিনে কীভাবে সম্ভব। আমরা প্রত্যাবাসন শুরু করতে চাই। প্রত্যাবাসন যেন টেকসই হয়, সে নিরিখে কাজ হচ্ছে।’

পরবর্তী পদক্ষেপ কী এবং প্রত্যাবাসন কখন শুরু হবে, জানতে চাইলে মিজানুর রহমান বলেন, মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ এখানে (বাংলাদেশ) আসবেন। রোহিঙ্গাদের সঙ্গে কথা বলবেন। সবকিছু করা হচ্ছে আস্থা অর্জনের জন্য। মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ বাংলাদেশে আসার পর জানা যাবে প্রত্যাবাসন কখন শুরু হবে।

রাখাইন পরিস্থিতি নিয়ে অসন্তোষ

আরআরআরসির সামনে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন রোহিঙ্গা প্রতিনিধিদলের সদস্য  মো. সলিম। তিনি বলেন, রাখাইনের বর্তমান পরিস্থিতি প্রত্যাবাসনের উপযোগী না। ছয় বছর আগে ফেলে আসা জন্মভূমিতে গড়ে তোলা হয়েছে দেশটির সেনাবাহিনী ও পুলিশের ব্যারাক, ফাঁড়ি ও চৌকি। কিছু জায়গাতে রোহিঙ্গাদের পুনর্বাসনের জন্য শেড তৈরি হয়েছে। ওই শেডে রোহিঙ্গারা থাকতে রাজি হবে না।

রাখাইনে ফেলে আসা জন্মভিটাতে রোহিঙ্গাদের পুনর্বাসন করা না হলে বাংলাদেশের আশ্রয়শিবিরে থাকা কোনো রোহিঙ্গা ফিরতে রাজি হবে না।

একই কথা বলেন রোহিঙ্গা প্রতিনিধিদলের সদস্য মোহাম্মদ তাহের (৪৫)। তিনি বলেন, ‘মিয়ানমারে ফিরে যাওয়ার মতো পরিস্থিতি ও পরিবেশ কোনোটাই নেই। তাঁদের (রোহিঙ্গা) গ্রামগুলো সেনাবাহিনীর দখলে। বাংলাদেশ থেকে ফিরে আবার আশ্রয়শিবিরে কেন রোহিঙ্গারা থাকবে? মিয়ানমার সরকার যদি সত্যিকার অর্থে রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে চায়, তাহলে নাগরিকত্ব প্রদানসহ জন্মভূমিতে পুনর্বাসনের উদ্যোগ নিতে পারে।’

মংডু শহর পর্যন্ত প্রায় ২০ কিলোমিটার সড়কের দুই পাশ দেখানো হয়েছে। দুই পাশে আগে যেসব রোহিঙ্গা গ্রাম ছিল, এখন তার কোনো চিহ্নই নেই। রোহিঙ্গা বসতিতে গড়ে উঠেছে নানা অবকাঠামো।
আবু সুফিয়ান, রোহিঙ্গা প্রতিনিধিদলের সদস্য

রোহিঙ্গা প্রতিনিধিদলের অপর সদস্য আবু সুফিয়ান বলেন, শুক্রবার সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত তাঁদের (রোহিঙ্গা প্রতিনিধিদল) রাখাইন রাজ্যের নাকফুরা থেকে মংডু শহর পর্যন্ত প্রায় ২০ কিলোমিটার সড়কের দুই পাশ দেখানো হয়েছে। দুই পাশে আগে যেসব রোহিঙ্গা গ্রাম ছিল, এখন তার কোনো চিহ্নই নেই। রোহিঙ্গা বসতিতে গড়ে উঠেছে নানা অবকাঠামো। রোহিঙ্গা প্রতিনিধিদলের সদস্য রহিমা খাতুন (৪০) বলেন, এমন পরিস্থিতিতে রোহিঙ্গারা রাখাইনে ফিরতে রাজি হবে না।

‘মডেল ভিলেজে’ সন্তুষ্ট না রোহিঙ্গারা
মংডু শহর থেকে উত্তর দিকে সাত কিলোমিটার দূরে রোহিঙ্গাদের পুনর্বাসনের জন্য তৈরি হচ্ছে বাংলাদেশের গুচ্ছগ্রাম আদলের মডেল ভিলেজ। কয়েক শ একর জমিতে তৈরি হচ্ছে প্রায় চার হাজার রোহিঙ্গা ধারণক্ষতার ১৫টি পৃথক ‘মডেল ভিলেজ’। ইতিমধ্যে নির্মিত হয়েছে পৃথক দুটি ভিলেজ। একটি ভিলেজে ২১৫ পরিবার এবং আরেকটিতে ৯৯ পরিবারের থাকার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে।

শুক্রবার দুপুরে রোহিঙ্গা প্রতিনিধিদলের সদস্যদের মডেল ভিলেজ দেখানো হয়। তখন রোহিঙ্গাদের বোঝানো হয়, মডেল ভিলেজে যাঁরা থাকবেন, তাঁদের সরকারি উদ্যোগে আড়াই কানি (এক একর) করে চাষাবাদের জমি দেওয়া হবে, রোহিঙ্গা ছেলেমেয়েদের স্কুলে পড়ালেখার সুযোগ দেয়া হবে, যা আগে হতো না।

বেলা দুইটা থেকে তিনটা পর্যন্ত দুই পক্ষের মধ্যে এক ঘণ্টার বৈঠক হয় মংডু ট্রানজিট কেন্দ্রের সম্মেলনকক্ষে। সেখানে মংডুর জেলা প্রশাসক অং জ লি ‘মডেল ভিলেজের’ ওপর নির্মিত একটি ভিডিও চিত্র উপস্থাপন করেন। তাতে সুযোগ–সুবিধার বিষয়গুলো উল্লেখ করা হয়। জেলা প্রশাসক রোহিঙ্গাদের ‘মডেল ভিলেজে’ ফিরে যেতে অনুরোধ জানান। জেলা প্রশাসক বলেন, বাংলাদেশ থেকে রোহিঙ্গারা মংডুর ট্রানজিট কেন্দ্রে পৌঁছানোর পর তাঁদের সর্বোচ্চ তিন দিন রাখা হবে। এরপর ট্রানজিট কেন্দ্র থেকে রোহিঙ্গাদের সরাসরি ‘মডেল ভিলেজে’ স্থানান্তর করা হবে।

মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের মংডুতে রোহিঙ্গাদের পুর্নবাসনের জন্য নির্মিত মডেল ভিলেজ পরিদর্শন করেন বাংলাদেশের টেকনাফ থেকে যাওয়া রোহিঙ্গা প্রতিনিধি দলের সদস্যরা
ছবি: সংগৃহীত

বৈঠকে রোহিঙ্গা প্রতিনিধিদলের সদস্য আবু সুফিয়ান ও গোলবাহার বলেন, টেকসই প্রত্যাবাসন করতে চাইলে রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব প্রদানের পাশাপাশি জন্মভূমিতে পুনর্বাসন করতে হবে। মডেল ভিলেজের মতো আশ্রয়শিবিরে কোনো রোহিঙ্গা থাকতে রাজি হবে না।

তখন মংডু জেলা প্রশাসক বলেন, রোহিঙ্গারা মংডুর ট্রানজিট কেন্দ্রে পৌঁছার পর প্রথমে নাগরিক হিসেবে এনভিসি (ন্যাশনাল ভেরিফিকেশন সার্টিফেকেট) দেওয়া হবে। পর্যায়ক্রমে এনআইডি প্রদান করা হবে। কিন্তু রোহিঙ্গারা তা মানতে রাজি হননি। প্রতিনিধিদলের সঙ্গে থাকা একাধিক সূত্র থেকে এ তথ্য জানা গেছে।

পুলিশ ও আরআরআরসি কার্যালয় সূত্র জানায়, গত ১৫ মার্চ মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের মংডু থেকে মিয়ানমারের ২২ সদস্যের প্রতিনিধিদল টেকনাফ এসে ১৭৭ পরিবারের ৪৮০ জন রোহিঙ্গার তথ্য যাছাই করেছিল। ওই তালিকা থেকেই ২০ সদস্যের রোহিঙ্গা প্রতিনিধিদল গঠন করা হয়েছে।  

২০ জনের রোহিঙ্গা প্রতিনিধিদলের মধ্যে টেকনাফের লেদা আশ্রয়শিবিরের (ক্যাম্প-২৪) ২ জন, শালবাগান আশ্রয়শিবিরের (ক্যাম্প-২৬) ১৪ জন এবং জাদিমুরা আশ্রয়শিবিরের (ক্যাম্প-২৭) ৪ জন রয়েছেন। এর মধ্যে রোহিঙ্গা নারী সদস্য তিনজন।

আরআরআরসি কার্যালয় সূত্রমতে, চীনের মধ্যস্থতায় ২০২২ সালের জানুয়ারি মাসে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন শুরুর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। তখন প্রত্যাবাসনের জন্য বাংলাদেশ থেকে যে আট লাখ রোহিঙ্গার তালিকা মিয়ানমারে পাঠানো হয়েছিল, তার মধ্যে থেকে পাইলট প্রকল্পের আওতায় প্রথম ধাপে ১ হাজার ১৪০ জন রোহিঙ্গাকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল। এর মধ্যে ৭১১ জন রোহিঙ্গাকে প্রত্যাবাসনে মিয়ানমারের সম্মতি পাওয়া গিয়েছিল। অবশিষ্ট ৪২৯ জন রোহিঙ্গার বিষয়ে মিয়ানমারের আপত্তি ছিল। বাংলাদেশ সরকারের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে মিয়ানমারের একটি প্রতিনিধিদল গত মার্চ মাসে টেকনাফে এসে ৪২৯ জন রোহিঙ্গার পাশাপাশি তাঁদের পরিবারে জন্ম নেওয়া আরও ৫১ জন শিশুর তথ্য সংগ্রহ করেন। রোহিঙ্গাদের আস্থা অর্জনের জন্য তাঁদের (রোহিঙ্গা) প্রতিনিধিদলকে রাখাইনের পরিস্থিতি দেখার সুযোগ দেওয়া হয়েছে।

বর্তমানে উখিয়া ও টেকনাফের ৩৩ আশ্রয়শিবিরে নিবন্ধিত রোহিঙ্গার সংখ্যা সাড়ে ১২ লাখ। এর মধ্যে আট লাখ এসেছে ২০১৭ সালের ২৫ আগস্টের পর কয়েক মাসে রাখাইন রাজ্য থেকে। রোহিঙ্গা ঢলের ছয় বছরেও একজন রোহিঙ্গাকে মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো সম্ভব হয়নি। এর আগে দুবার প্রত্যাবাসনের উদ্যোগ নেওয়া হলেও রোহিঙ্গাদের অনীহার কারণে তা ভন্ডুল হয়েছিল।